সত্য বহুমাত্রিক। জৈন তীর্থঙ্কর বললেন, সত্য অন্ধদের হস্তী স্পর্শনের মতন। কেউ লেজ ধরে বলবে, সরু। কেউ পা ধরে বলবে থামের মত। কেউ পেট ধরে বলবে, মোটা। এই উদাহরণটি পরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন।
সত্য বহুমাত্রিক শুধু না, সত্য বাস্তবাচ্ছাদিতও। একটা খুনের ঘটনা বাস্তব। তার পিছনে খুনীকে খুঁজে বার করে তার মোটিভটা জানাই হল খুনের পিছনে সত্য। আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক। একটা লাঠি জলের মধ্যে ডুবে বাঁকা দেখায়। এ বাস্তব। এর পিছনে কারণটা জানতে পদার্থবিদ্যার সত্যকে খুঁজতে হবে।
এরকম নানা ভাবে বাস্তবের আড়াল সরিয়ে সত্যের সন্ধানে দার্শনিক, বিজ্ঞানী আর গোয়েন্দাদের কাজ চিরকালের। বাস্তবকে আমরা তাই বলি, আপাত সত্য। সব বাস্তবই আপাত সত্য।
যা জানার সত্য, আর যা অনুভবের সত্য, এরা তো আবার স্ববিরোধীও হয়ে দাঁড়ায়। যে জানে আর যে অনুভব করে, সে এক না দুই? যে জানে আর যে অনুভব করে দুজনকেই জানে চেতনা। নিজের ভিতরে সামঞ্জস্য তৈরি করতে হিমশিম খায় মানুষ। যদি না, সে মেনে নেয় সবটাই সত্য। অনুভবের সত্যকে উপেক্ষা করলে মানুষ কপট হয়, জানার সত্যকে উপেক্ষা করলে হয় বোকা।
পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। তথ্য বলছে এ পাথর। অনুভব বলছে আমার ভক্তির এ মাধুর্যময় রূপ। এ পাথরের বেশি। একজন মানুষ। শারীরবিদ্যার জানা সত্য বলছে, এ নানা রাসায়নিক পদার্থের জটিল সংমিশ্রণ। অনুভবের সত্য বলছে, এ আমার সন্তান, এ আমার ভালোবাসা, এ আমার ভাই। এ রাসায়নিক পদার্থের থেকে অনেক বেশি কিছু। ধাতব তন্ত্রীতে লাগছে আঙুলের টোকা। উঠছে ধ্বনি। পদার্থবিদ্যার জানা বলছে, এ ধ্বনিবিদ্যা। অক্টেভ সূত্রে বাঁধা। অনুভব বলছে, এ যে মিঞা মল্লার, আমার চেতনা জুড়ে জমেছে মেঘ। এই দেখো আমার সজল আঁখি।
তবে সত্য কি? সত্য সহস্রদল পাপড়ি। তবে মিথ্যা কি? মিথ্যা তাই, যা আমার জানাতেও নেই, আমার অনুভবেও নেই। যা নেই, তা-ই মিথ্যা। যা আছে, সে অনুভবে কি জানায়, যেখানেই থাকুক, তা সত্য। তাই তাজমহল কবরস্থান নয়। একটা লাঠি আর একটা বলকে ঘিরে অতগুলো মানুষের দৌড়ঝাঁপ পাগলামি না, ওটা ক্রিকেট। আমার দেশের অনুভব জড়িয়ে। তাই সে সত্য।
তবে মিথ্যার শরীর জন্মায় কিসে? সে তো একটু আগেই বললাম, না আমার জানায় সে আছে, নাতো আমার অনুভবে। তবে সে কোথায় থাকে? সে থাকে ভাষায়। মানুষের মধ্যে শারীরিক চোখের দৃষ্টি, বোধের দৃষ্টি ছাড়া আরেকটা দৃষ্টিশক্তি আছে। সে ভাষার চোখ। ভাষায় সে গল্প বলে। গল্প দেখে। মনের মধ্যে ভাষার মানচিত্র গঠন হয়। সেই ভাষার শরীর জুড়ে জন্মায় মিথ্যা। যে জ্ঞান আমার জানাতে নেই, আমার অনুভবে নেই, তাকে আমি আমার ভাষায় জন্ম-দিতে পারি স্বার্থ চরিতার্থের জন্য। এই 'জন্য' শব্দটা এখানে খুব জরুরি।
মিথ্যার কোনো সংশয় থাকে না, মিথ্যার কোনো 'কারণ' থাকে না, 'জন্য' থাকে।
যে কোনো ঘটনার দুটো ব্যাখ্যা হয়। এই কারণে এটা ঘটল। এর জন্যে এটা ঘটল। যখন বলি মহামারী ঘটল আমাদের পাপের জন্য, তখন সেটা আমার জানা বা অনুভব থেকে বলছি না, আমার মধ্যের অনুমান শক্তি দিয়ে বলছি। যে অনুমান শক্তি কাউকে দোষী না করে কোনো কিছুর কারণ পায় না। কারণ সমাজে সে ন্যায্য অন্যায্য কারণে বারবার দোষী হয়েছে। যদি বলি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিসের জন্য সৃষ্টি হল, তবে এই 'জন্য' এর কোনো অর্থ হয় না। ধর্ম নানা গল্প শোনায়। সে অনুমান। সে জানার বা অনুভবের কিছুর সত্যই নয়। এতো জোর দিয়ে কি করে বলা যায়? কারণ আমাদের সবার জানার বা অনুভবের একটা প্যাটার্ন হয়। সেই প্যাটার্ন অনুযায়ী সব কিছুকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। সেই প্যাটার্ন অনুযায়ী আমরা নানা বিদ্যাকে আলাদা আলাদা করি। সেই প্যাটার্নের বাইরে গেলে আমরা তাকে অস্বাভাবিক বলি। আগুনে হাত দিয়ে কেউ জ্বালাপোড়া অনুভব না করলে আমরা সেটাকে স্নায়বিক রোগ বলি। রসগোল্লাকে তেতো বললে সে রোগের লক্ষ্মণ হয়।
ভাষা আর অনুমানশক্তি - এরা সংসারে বেশিরভাগ সমস্যার মূল। ইতিহাস আর অভিব্যক্তি - একই বিষয়। ডারউইন যখন সৃষ্টির ইতিহাস শোনালেন, তখন অনেক অনুমান আর তার স্যাঙাত ভাষার আয়ু ফুরালো। কিছু মানুষ মানতে চায় না বলে আজও তারা দুজন পাশ্চাত্যের অনেক শিক্ষালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুনি রিচার্ড ডকিন্সের কাছে।
তবে এই অনুমান ও ভাষার স্যাঙাতপনায় শুধুই কি খারাপ হয়েছে? তা ঠিক নয়। কারণ হাইপোথিসিস দাঁড়ায় কি করে তবে। সমস্যা হয় অনুমান যখন জ্ঞানের ভান করে। সে যখন কিছুতেই মানতে চায় না যে সে আসলে অনুমান, জ্ঞান নয়। ভাষা তাকে সে কাঠিন্য দিতে অবশ্যই সাহায্য করে।
তবে সত্যের এই যে অনন্তরূপ, এর কি কোনো প্যাটার্ন আছে? আছে। ক্রমবিবর্তনের সত্য। ক্ষুদ্র সত্য থেকে বৃহৎ সত্যের দিকে যাওয়ার রাস্তা। সে বৃহৎ মানে সু-উচ্চ নয়। সে আরও আরও উদার। দিন রাত্রির বিরোধীতা যেমন এক আহ্নিকগতি বুঝলেই মেটে। তেমনই আমাদের দরকার সেই উদার সত্যের দিকে যাওয়া, যে সত্য আমায় ক্ষুদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করবে। 'অসতো মা সদ্গময়' - তাই মানুষের প্রাচীন প্রার্থনা।