যে মানুষ হরগঞ্জ বাজারে, কি বড়বাজারে হইহই করে বাজার করে, তাকেই দেখেছি সেন্ট্রাল এসি চালিত ধোপদুরস্ত শপিংমলে কী শান্ত হয়ে কেনাকাটা করছে।
একই মানুষের এই দুটো রূপই সত্যি। মানুষের মধ্যে একটা ভীষণ ক্ষমতা আছে পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার। যে কথাটা সব চাইতে জোরে শোনা যাচ্ছে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নেওয়ার। যে সন্দেহটা সবাই করছে সেই সন্দেহটাকেই একমাত্র সন্দেহ বলে ধরে নেওয়ার।
প্রচণ্ড উত্তাল যখন চারদিক তখন শান্ত রোজকারের জীবনে একটা প্রচণ্ড উত্তেজনা এসে ধাক্কা দেয়। কীভাবে সেই উত্তেজনাকে প্রশমিত করবে, প্রকাশ করবে কিছুই ঠিক করতে না পেরে হুড়মুড় করে একদিকে ঝুঁকে পড়ে মানুষ। বিশ্বাস করে সবাই যেটা বলছে সেদিকেই চলাই নিরাপদ। এই উত্তেজনাটাই এখন সত্য।
মনের মধ্যে প্রতিবাদের স্বর কোনটা আর সোশ্যালমিডিয়া আর নিউজচ্যানেল দ্বারা প্রণোদিত উত্তেজনা কোনটা স্বাভাবিকভাবেই আলাদা করে উঠতে পারে না মানুষ। যে বাইরে থেকে শান্ত হয়ে থাকে, তাকে কাপুরুষ বলে। যে মনের মধ্যে কঠোর অপেক্ষায় একটা সঠিক বিচারের অপেক্ষায় আছে, তাকে অলস অসংবেদনশীল ভাবে।
এ ভ্রান্তিটাও স্বাভাবিক। প্রবল উত্তেজনায় নিজের স্বভাব নিজের স্ব-ভাবে থাকে না।
কিন্তু প্রতিবাদটা জন্মায় অনেক গভীর থেকে। সেখানে অনুকরণের কিছু নেই। সেখানে একটা গভীর জ্বালা, অসন্তোষ আছে। একটা অসম্ভব নিদ্রাহীন যন্ত্রণা সত্যের জন্য চাতকের মত তাকিয়ে বসে আছে। অন্যে তাকে নিয়ে কী বলছে তার আসে যায় না, সত্যের উদয় কখন কোন মুহূর্তে হবে তারই প্রাণান্তকর প্রতীক্ষা তার। অতন্দ্র প্রহরা তার।
দুর্বল মন উত্তেজনায় বিবশ হয় সহজে। বিভ্রান্ত হয় সহজে। সে তখন সাঁতারুর প্রবল বেগে হাত পা ছোঁড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যে যত জোরে হাত পা ছোঁড়ে তাকে সে তত বড় মাপের সাঁতারু মনে করে। যে অত্যন্ত সংযত হয়ে ওপারে সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে সে ভাবে দুর্বল।
গভীরে অসন্তোষ যদি সত্যি হয়, গভীরে সত্যের প্রকাশের জন্য আগ্রহ যদি আন্তরিক হয়, মিথ্যার আস্ফালনকে যদি মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে ধিক্কার জানানোর বল থাকে, তবে প্রকাশের উপায় আপনিই বেরিয়ে আসবে। সাচ্চা প্রতিবাদী কখনও অপ্রতিবাদী-মৃদুপ্রতিবাদী-কঠোর প্রতিবাদীর বিচার করে বেড়ানোর সময় পায় না। যে ভিতর থেকে জেগেছে তার রাস্তা নিয়ে সংশয় নেই, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না সে। কিন্তু যে বাইরের উত্তেজনায় মেতেছে, বাইরে থেকে প্ররোচিত হয়েছে, বাইরে থেকেই সবটুকু তাগিদ জন্মেছে….সেই মনের মধ্যে হঠাৎ জাগা উত্তেজনাকে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়। কারণ উত্তেজনার মধ্যে অনুকরণের দিকে যে ঝোঁক থাকে তার সঙ্গে সত্যের সঙ্গে সঙ্গতি ভীষণ কম থাকে। অসংগত আবেগ, অসংগত আক্রোশ, অসংগত চরিত্রহননের ছবিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকে। “এদের চিনে রাখুন, এরা এই সময়েও রিল বানিয়েছে, কবিতার অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়েছে…..” ইত্যাদি ইত্যাদি। এ অসংগত আক্রোশের ভাষা উত্তেজনার ভাষা। অতন্দ্র জেগে থাকা হল সত্যের জন্য প্রাণপাতী অপেক্ষা, সাধনা। তাকে উত্তেজনায় পাওয়া যায় না। ফেয়ারনেস, ন্যায় যা-ই বলি না কেন, নিজের অন্তর্দৃষ্টিকে উত্তেজনায় বিবশ করে, বাইরের উত্তেজনায় সবটুকু সমর্পণ করে বসে থাকলে চোখের সামনে দিয়ে ফাঁকির রাস্তা বার করা সহজ হয়ে যায়। এ উদাহরণও আমাদের সমাজেই আছে। প্রবল উত্তেজনা একদিন শান্ত হয়ে যায় ক্লান্তিতে, অবসাদে। তারপর আর কেউ খোঁজটুকু নেয় না, আচ্ছা তার বিচার কী হল?
তবু এ হবে। ওই যে শুরুতেই বললাম, মানুষের মধ্যে প্রভাবিত হওয়ার আর প্রভাবিত করার এক প্রবল ক্ষমতা আর বাসনা আছে। তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের অন্তর্দৃষ্টি নির্ভর চলতে শেখা স্বচেষ্টা নির্ভর। অট্রেণ্ড্রীয়।