Skip to main content

এমন মানুষের সামনে তো আমাদের বসতেই হয় যে মানুষটা হয় তো আর কয়েক মাস পরে মারা যাবে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন। যে মানুষটা মারা যাবে সে অনেক সময় স্পষ্টভাবে জানে, অনেক সময় আন্দাজে জানে। বেশির ভাগ সময়েই সে তথ্যে জানে না, কিন্তু অনুভবে জানে, সে আর থাকবে না। আমি দেখা করতে গেছি, যেমন আপনারাও কখনও না কখনও দেখা করতে গেছেন, 'অন্য কথা' খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। 'স্বাভাবিক আচরণ' করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু কি কঠিন। যেন অলক্ষ্যে আমার অভিনয়ের পরীক্ষা হচ্ছে। নিখুঁত অভিনয় করতেই হবে। হাসিটা মুখের কোনায় থাকতেই হবে। 

    হাস্পাতালে এই সংকটটা নেই। কারণ সেখানে আসন্ন মৃত্যুর মঞ্চ বাঁধা। যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে সব কিছু সে হয় জ্ঞানে নেই, না হয় বোধে নেই। যদি থাকেও বা, সেখানে কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। কারণ সে খুব 'সিরিয়াস', আইসিইউ এর বাইরে তার নামের পাশে লেখা আছে, অবস্থা সংকটাপন্ন। 

    সংকট হয় সেই মানুষটা যখন হেঁটে চলে বেড়ায় সামনে। আপনার সামনে হয় তো চায়ের কাপটা এগিয়ে রাখল। একটু হেসে বলল, "পরের বছর পাব কিনা তো জানি না।" নিজেকে তখন অপরাধী লাগতে পারে, অস্বস্তি হতে পারে, কারণ আমার জীবনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তো কিছু বিপন্নতার আশঙ্কা নেই, মানে আমি অন্য তটে আপাতত। তখন এক লহমায় মিথ্যা কথা ছুঁড়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে হয়, পরিস্থিতিকে সত্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়, "আরে ধুর, এরকম রোগে আমার অমুক ভালো হয়ে চলে এলো, আজকাল কতরকম চিকিৎসা বেরিয়ে গেছে, আপনার/ তোমার কিচ্ছু হবে না দেখে নিন/নিও। আমার অমুকের তো তোমার/আপনার থেকে খারাপ অবস্থা ছিল".... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলেই যাচ্ছি। থামতে ইচ্ছা করছে না। মনে হয় আরও কত জোর দিয়ে বললে মিথ্যাকে সত্যের মত শোনায়? আরো আবেগ দিয়ে বলব না আরো স্বাভাবিকভাবে বলব? নিজের কানেও বিশ্বাসযোগ্য লাগতে হবে তো। বারবার চোখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। সেও চোখ সরিয়ে নেবে। কারণ সেও জানে এই কথাগুলো আমরা দুজনেই শুনতে চাইছি, ভাবতে চাইছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। শরীরের একের পর এক বদলক্ষণ বুঝিয়ে যাচ্ছে - প্রস্তুত হও। 

    হাস্পাতালের বাইরে এই 'প্রস্তুত থাকবেন' শোনা মানুষেরা বেঞ্চে, মেঝেতে শুয়ে বসে দিন কাটায়। পাশের মানুষের সঙ্গে গল্প করে। গল্প করতে করতে খেই হারিয়ে যায়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার এলে উদ্বিগ্ন চোখে দৌড়ে যায়। আবার এসে বসে। চরম সংকটে যাওয়া রোগীর বাড়ির লোকেদের ছোটাছুটি দেখে। তাদের প্রস্তুতির সময় শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারে। তাদের বাড়ির লোকের আছাড়িপাছাড়ি কান্নার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নখ কাটে। চা খেতে ওঠে। বিড়ি বা সিগারেট ধরায়। তাকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। চেনা রাস্তাঘাট, লোকজন সব অচেনা লাগে। সবাই যেন সুতোর উপর ঝুলছে। একটু এপাশ ওপাশ হলেই ছবিটা বদলে যাবে। আবার এসে আগের জায়গায় বসে। ওদের বাড়ির লোক তাদের সংসারের দুয়ার পেরিয়ে যাওয়া মানুষটার সাদা চাদরে ঢাকা জীবনের পরম আশ্রয় শরীরটাকে নিয়ে ঘড়ঘড় করে চাকার আওয়াজ তোলা ট্রলিতে সাজিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের বাঁকে। আবার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকা। 

    খানিক বাদেই আবার চঞ্চলতা। নতুন রোগী এলো। অবস্থা ভালো নয়। কোথায় ওষুধের দোকান, কোথায় মেঝেতে শোয়ার প্লাস্টিক পাওয়া যাবে, কোথায় ভালো চা বানায়, কোন ডাক্তারের কথা খুব ভালো, কে খিটখিটে… এইসব আলোচনা শুরু হবে। একটু একটু করে পরিচয় হবে। তারপর হঠাৎ সব ফুরিয়ে যাবে। আর অপেক্ষা নেই। আর উদ্বেগ নেই। শুধু কয়েকটা নিয়ম। হাস্পাতাল থেকে বেরোনোর সময় অন্যদের আশঙ্কায় বাঁচা মানুষদের শুভাকাঙ্ক্ষা জানিয়ে যাওয়া। আবার একরাশ মিথ্যা বলা। ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখা। যে ঈশ্বর অতিব্যবহারে, অপব্যবহারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। তারপর দিন যায়, আর কেউ কাউকে চিনি না। আবার নতুন অধ্যায় শুরু। আমরা আর কথা বলি না শেষ অধ্যায়ের দিনগুলো নিয়ে। 

    আর যারা শেষদিনের মানুষটার নিত্যসঙ্গী থাকে? তারাও প্রতিদিন অল্প অল্প করে মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শিখে যায়। জানে একদিন ধরা পড়ে যাবে। তবু রাতদিন মিথ্যার পর মিথ্যা, আশার পর আশা জাগিয়ে ছোটোবেলার মত খেলার দুনিয়া বানিয়ে নিতে হয়। সেখানে সব মিছিমিছি। কিন্তু সব ভীষণ দরকারি। চলমান, ঘটমান জগতের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ নেই সেখানে। কারণ সেখানে একজন মানুষ অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার অল্প অল্প ফুরিয়ে যাওয়ার সাক্ষী থাকা মানুষেরাও, খুব কাছের মানুষেরা অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যায়। প্রতিদিন মাথায়-বুকে জমা আবর্জনা দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠার আবর্জনা সরিয়ে রোজ আবার নতুন করে দাঁড়াতে শিখতে হয়। সে লড়াই একার লড়াই। মিথ্যাই তখন সঞ্জীবনী। তারপর একদিন সত্য উৎকট শোকে সব শান্ত করে দিয়ে যায়। তারপর শুধু শূন্যতা। ঝরা পাতার স্তুপ জমিয়ে আগুন লাগানোর অপেক্ষা। আগুনের হল্কায় পুড়ে আবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা। 

    কোনো মৃত্যুই শুধু একটা প্রাণ নিয়ে ফিরে যায় না, সঙ্গে আরো কিছুও নিয়ে যায়, আমরা সে সবের হিসাব রাখি না, মানে রাখতে চাই না। মৃত্যুর কাছে আমরা জন্ম থেকেই সবটুকু ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ যে!