Skip to main content

তুমি আদিকবি কবিগুরু তুমি হে....

এই আদিকবি কে গা? দেখেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। মানে উপনিষদের ভাব থাকতে পারে। আচ্ছা, গানটা একবার পড়ে দেখা যাক।

 

     প্রথম আদি তব শক্তি--

আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে

          গগনে গগনে ॥

 

তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,

জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে ॥

 

তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,

     প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে।

 

তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,

    মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে ॥

 

কতবার 'আদি' কথাটা লিখছেন তিনি? চারবার।

আদি শক্তি। আদি পরমোজ্জ্বল। আদি বাণী। আদি কবি।

 

আচ্ছা, এই আদি কবি কি পুরুষ? মনে হয়। কারণ কবিগুরু বলছেন। গুরু বললেই কেমন একটা পুরুষ পুরুষ শোনায় না? তাছাড়া রবি ঠাকুর থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সব্বাই লিখেছে মেয়েদের কবিতাটা ঠিক আসে না। এই নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসে লাভ নেই। পড়েচি, তাই বলেচি। আমি অবশ্যি সহমত নই। কিন্তু আমার মত চুনোপুঁটির আবার মত। যাক গে। তো কথা হল ইনি কি সেই আদিশক্তি, মানে আদিকবি, মানে আদিপুরুষ?

উপনিষদে আদিপুরুষের কথা আছে। গীতায় পুরুষোত্তমের কথা আছে। মানে যিনি সমস্ত সত্তার মূল সত্তা। মানে ইঞ্জিরিতে বললে অন্টোলজিকালি আর কি। সেই গীতায় আছে না, আমিই সূত্রের মত গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আছি। এইসব কথা উপনিষদে আছে তো। পড়িচি তো। এখন কথা হল এই আদিপুরুষ যিনি তিনি আবার পৌরাণিক যুগে অবতার হয়ে এলেন। তাঁদের জীবনকে বলা হল লীলা। কিন্তু সেইখানেও কথা আছে। গীতায় আছে, ওসব গপ্পো পড়ে গেলে হবেনি বাপু…. আমাকে তত্ত্বের মধ্যে জানতে হবে।

"Those who understand the divine nature of My birth and activities, O Arjun, upon leaving the body, do not have to take birth again, but come to My eternal abode." 4/9

তবে সেই উপনিষদের নিরাকার আদিপুরুষ, যদি আকার মানুষ শরীরধারীও হন, লীলার জন্য, তাঁকে আর পাঁচটা মানুষের মত দেখলে তো হবে না, এই শাস্ত্রীয় মত।

তত্ত্বের মাধ্যমে মানে কি? না তিনি এই সমস্ত সৃষ্টির মূল সত্য, এ জানতে হবে। এই জানা আবেগের জানা নয়, এই জানা তত্ত্বের মাধ্যমে জানা। মায় অতবড় পৌরাণিক ভক্ত নারদজী, যাকে কেন্দ্র করেই এতবড় বৈষ্ণব আন্দোলনের তত্ত্ব, তিনিও বলছেন যে যদি গোপীরা কৃষ্ণকে পরমসত্য না জানতেন তবে তাদের তো অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর জন্য ব্যাভিচারিণী বলা হত….

22. in the case of the gopīs, one cannot criticize them for forgetting the Lord's greatness.

23. On the other hand, displays of devotion without knowledge of God's greatness are no better than the affairs of illicit lovers. (Naradiya Bhakti Sutra)

তবে কথা হচ্ছে তত্ত্বত জানতে হবে। রাতদিন আবেগে ভাসিয়ে বা ভেসে লাভ নেই। এখন এই তত্ত্বত জানা মানে ওই যে বললাম অন্টোলজিক্যালি জানার দরকার। অন্তত আমাদের সমাজে যারা দেশে-বিদেশে স্বীকৃত মহাপুরুষ তাদের সবারই এক কথা। রামভক্ত ত্যাগরাজ, কবীর, তুলসী, কৃষ্ণভক্ত মীরা, সুরদাস, দাদু…নির্গুণ নিরাকার ভক্ত নানক, আবারও কবীর। আধুনিক যুগের রামকৃষ্ণদেব, রমণ মহর্ষি, প্রমুখেরাও একই কথা বলেছেন, সাধনার মাধ্যমে তত্ত্বত জানতে হবে। এ ছেলের হাতের মোয়া নয়। এ গল্প নয়। এ শরীরের পরিচয়ের জন্য না, এ আত্মার পরিচয়ের জন্য। শরীর দেশ-কাল ইত্যাদিতে বিভক্ত। আত্মা নয়। সেই আত্মাকে, অর্থাৎ সর্ব ভূতের অন্তর্যামী সত্যকে জানতে হবে। এই হল গিয়ে শাস্ত্রীয় কথা।

এখন কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় খাওয়ার জিনিস যদি মাথায় পড়ে তবে তা বিরক্তির কারণ হয়। আরো দুষ্টু উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। প্রেমিক প্রেমিকা যদি চিকিৎসক হন কর্মসূত্রে, এবং ঘনিষ্ঠ আবেগী মুহূর্তে যদি নিজেদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখেন, তবে কি পরিণাম হবে বলাই বাহুল্য। তা বলে কি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্ব নেই? বেশ আছে। কিন্তু নিজের নিজের জায়গায় আছে।

এখন শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্যকে সরিয়ে যদি তাদের উপাদানগুলো নিয়ে অন্য কাজে লাগানো হয়, তবে তো সমস্যা। পৌরাণিক গল্পকে গল্পের মত করে দেখালে কোনো গোল হয় না। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে সে কাজে নামলে তো গোল হয়। সেই যে সুকুমার রায়ের 'মামা গো' গপ্পে আছে না, মামা ভাগ্নেকে একটা প্রাইজ দেবে বলেছিল। কিন্তু ভুলে গেছে। ভাগ্নে তখন নানা অপ্রাসঙ্গিক গল্পের সূত্রপাত করে প্রসঙ্গে আসতে চাইছে। মোদ্দাকথা সে প্রাইজ নিতে চায়।

তবে আমার মোদ্দাকথাটা কি দাঁড়ালো। আমি আদিপুরুষ বলতে কার গল্প শুনতে যাব? আমাদের উপনিষদ গীতা ইত্যাদির যিনি আদিপুরুষ, নাকি এই আধুনিক আদিপুরুষ? কারণ আমি যদ্দূর পড়েছি বাল্মীকি বেদ-উপনিষদের আদিপুরুষতত্ত্বকেই খাঁড়া করতে চেয়েছেন। ব্যাসদেবও তাই। আর তুলসীদাস যদিও ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাফাই গাইতে দু এক জায়গায় সর্ব ভূতের মূল সত্য তত্ত্ব থেকে সরেছেন, তাও সামলিয়ে নিয়েছেন মোটামুটি।

আসলে কথাটা হচ্ছে, তত্ত্ব অনুযায়ী নাম পরিচয়? না, নাম পরিচয় অনুযায়ী তত্ত্ব? যদি তত্ত্ব অনুযায়ী নাম পরিচয় হয়, তবে রাম-কৃষ্ণ-আল্লাহ-গড ইত্যাদিতে পার্থক্য নেই, যা রামকৃষ্ণদেবের জীবনীর মূল সুর। আর যদি নাম পরিচয় দিয়ে তত্ত্ব খাঁড়া করতে যাই, তবে তো গোড়ায় গোলমাল।

আর যদি বলেন, আমি তো নাস্তিক, এ সব মানি না। তবে কথাটা সত্যি হয়, কিন্তু বাস্তব হয় না। আসলে বাস্তবটা হল, আমার মানা, না মানার কথা নয়, আমি কি যথাযথ শিক্ষাটা পেয়েছি, নাকি আমাকে সিলেবাস বদলিয়ে যা কিছু শেখানো যায়? নিজেকে শিক্ষিত করার কোনো দায়িত্ব আমি নিইনি।