সৌরভ ভট্টাচার্য
26 January 2019
প্রজাতন্ত্রদিবস। অবশ্যই ভারতের। যদিও ‘দেশ’ শব্দটা পরিসর হারাচ্ছে ‘বিশ্ব’ শব্দের কাছে। হারারির মতে আমরা যদি একটা বিশ্বনীতিতে না দাঁড়াই তবে ক্রমে আমাদের এ বিশ্ব বাসযোগ্য রাখা কঠিন হবে। তোমার দেশের বাতাস দূষিত হলে তার ফল আমিও ভুগি, তোমার আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেল সেই তাপে আমিও পুড়ি, তোমার অসংযমের দায়ে আমার দেশেও অকাল বন্যা, খরা। এসো একটা নীতি বানাই, বিশ্বনীতি। এখন ই-কমার্সেও বিশ্বনীতির ডাক এসেছে। বিতর্ক হচ্ছে। হবে, সে আলাদা কথা। কিন্তু আমার কথা আজ নিজের দেশ নিয়েই। প্রজাতন্ত্র দিবস।
দেশে নানা প্রজা। গরীব আর ধনী, ইংরাজিতে ‘আছে’ আর ‘নেই’ প্রজা। উপেক্ষিত আর তোষিত প্রজা। সেই নিয়েই কথা। একটা ঘটনা, গত জুলাইতে থাইল্যাণ্ডে ঘটেছিল। বারোটা বাচ্চা একটা গুহায় আটকে পড়েছিল। সারা বিশ্বে হইচই পড়ে গেল। নানা দেশ থেকে নানা কুশলীরা এলেন, গুহার জল নিষ্কাশিত হল, বাচ্চাগুলো উদ্ধার পেল। আমাদের দেশেও সে সংবাদে বৈদ্যুতিক আর ছাপা মাধ্যম দুই-ই লাভের মুখ দেখেছিল। একটা থ্রিলারের মত গপ্পোটা বানানো হয়েছিল। আর ফেসবুকে... ”আহারে বাচ্চাগুলো... বেরোলো কি?... ঘুমাতে পাচ্ছি না..” ইংরাজিতে, বাংলায়, হিন্দীতে... নানা পোস্ট... ছবি... ইত্যাদি। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক। সহমর্মিতা খুব ভালো গুণ।
এবার ঘটনা, মেঘালয়। পনেরোজন শ্রমিক। মালিকের লোভে গর্তে গেল, অভাবের অসহায়তায়। তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল কিনা জানি না, টুইট করত কিনা জানি না। সেই থাইল্যাণ্ডের গুহার বাচ্চাগুলোর কথা জানত কিনা জানি না। কিন্তু তাদের পরিবার ছিল, খিদে ছিল, সাধ ছিল, বাঁচার ইচ্ছা তো নিশ্চয় ছিল। এগুলো থাকতেই হয়। কিন্তু মানবাধিকারের জ্ঞান ছিল না। জন্ম থেকেই মানুষ হয়ে জন্মানোর যে সম্মানটুকু পাওয়া উচিৎ, তা জানত না, উচ্চ উপার্জনক্ষমতারহিত হওয়ায় সে আশাটুকু বাতুলতা যদিও। আমাদের পাণ্ডিয়ার টিপ্পনী আছে, ভোটের কাজিয়া আছে, কত রকম ‘বাদ’ এর আনুগত্যরক্ষা আছে, নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়া তথা জগত সংসারে টিকিয়ে রাখার দায়ের চেয়ে অধিক সোচ্চারে জাঁকিয়ে রাখার দায় আছে। ইত্যাদি নানা নানা সমস্যা তো আছেই। যা নেই তা হল একটা স্বাবলম্বী মানবিকতাবোধ। যার একটা বড় দিক হল সবল সহমর্মিতা। ফেসবুকীয় হাওয়াগামী সহমর্মিতা নয়, স্ব-বিশ্লেষণ ক্ষমতাযুক্ত সহমর্মিতা। তার দায় কে নেবে? সে সময় কোথায়?
উদ্ধারকাজ চলছে। কি উদ্ধার হচ্ছে? দেহের পচা-গলা বিচ্ছিন্ন অংশরা টুকরো টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসছে। যন্ত্র দিয়ে ধড়টা টানতে গেলে মাথাটা আলাদা হয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে। বাড়ির লোকেরা তাই নেওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। অভিযোগ জানাচ্ছে না যে তা নয়। তবে খুবই ক্ষীণ সে অভিযোগের কণ্ঠস্বর। তারা বলছে আপনারা ওই দেহের অংশগুলোই একটু পরীক্ষা করে জানিয়ে দিন কার, আমরা তারই সৎকার করে নেব। আপনারা কাপড়ে জড়িয়ে দিলেই হবে।
কি ছোট্টো চাহিদা না? কি অল্প। মারা গেল তো কি হল। গরীব তো ওভাবেই মরবে বলে জন্মেছে। তবে এ ঘটনা আজ বিশ্বের আকর্ষণ আসবে কি করে? নিজের দেশের মানুষের উদাসীনতা পেরিয়ে বাইরের সহমর্মিতা এসে পৌঁছাবেই বা কি করে? কেমন দৃষ্টিকটু লাগে না আমাদের? আমরা যতই যা হই, একটা উচ্চ-সংস্কৃতিসম্পন্ন জাত। দেশের মানুষের চাইতে আমাদের ভাবাবেগ অনেক অনেক বেশি দামী। বিবেকানন্দ বলেছেন না, ভারত মরে গেলে পৃথিবীর সব উচ্চভাব নাকি এক্কেবারে মরে যাবে। তবে? সেগুলো রাখতে ব্যস্ত থাকব, না কে গুহায় ঢুকে মরল তা নিয়ে ভাবব। ও তো ওদের কর্মফল, নাকি?
আমি জানি না নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচিত হলে দেশের কি ক্ষতিবৃদ্ধি হবে, জানি না পাণ্ডিয়ার উক্তিতে দেশ ক ইঞ্চি মাটির তলায় ঢুকল, আমি জানি না কোন নেতা দেশের সর্বোচ্চ আসনে বসলে এমন একটা নির্দয়, কূপমণ্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক জাতের ঘুম ভেঙে তরতর করে একটা সঠিক অর্থে সভ্য দেশ হয়ে উঠবে, আমি জানি না কোনো নারীর কুমারীত্ব আয়াপ্পাকে বিচলিত করলে কি কাণ্ড ঘটে যাবে, আমি জানি আজ যে পতাকাগুলো পত পত করে উড়ছে সেখানে পনেরোটা পচাগলা শরীরের মাংস, রক্তের দাগ লেগে। দুর্ঘটনাটা দুর্ঘটনাই। কিন্তু উদাসীনতাটা লজ্জার। তাই আজকের দিনটা সেই পরিবারের দিকে তাকিয়ে লজ্জার, যে পরিবারগুলো এখনও গর্তটার সামনে বসে। যাদের পাশে যন্ত্র আছে, কর্মী আছে, সহমর্মিতা নেই।