শবরীমালাতে রজঃস্বলা নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে যিনি একমাত্র বিরোধীতা করলেন সুপ্রিম কোর্টে রায়দানের সময়, তিনি একজন মহিলা বিচারপতি। তার বক্তব্য - ধর্ম আর প্রথার সাথে যুক্তির কোনো সম্পর্ক থাকা উচিৎ নয়।
কথাটা দু’ভাবে দেখা যেতে পারে। এক, মহিলা হলেই যে তার মহিলাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকতে হবে সেটা কোনো কাজের কথা নয়। তিনি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী রাখতেই পারেন। দুই, একটা চিন্তার কথা হল এই যে, একজন মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, একটা প্রথা আর বিশ্বাসের বিরোধীতা করা যুক্তির সাজে না, যে যুক্তি নারীদের পক্ষে বলে নয়, যে যুক্তি মানুষের সমান অধিকারের পক্ষে কথা বলছে।
প্রথা বনাম যুক্তি
==============
প্রথা, বিশ্বাস এগুলোকে ধ্রুব মনে করা হয়, কারণ এগুলোতে দীর্ঘদিন কোনো পরিবর্তন আসে না। মজা হচ্ছে, যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সব সুবিধা নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ নির্ভর আলো-পাখা-কম্পিউটার-এসি আরো নানা সামগ্রীতে ভরপুর। যান-বাহন সব কিছুই আধুনিক। এমনকি সেই ধর্মের প্রতিনিধির অনেকেই এরোপ্লেন ছাড়া যাতায়াত করেন না এমনও জানি। কিন্তু চিন্তার জগতে সেই বিজ্ঞানের গতি নৈব নৈব চ। তখন সেই আমরা পুরাতনপন্থী, প্রাচীনপন্থী। ঐতিহ্যের নামে যা কিছু অবৈজ্ঞানিক, অসত্য প্রতিষ্ঠ তার অনুসারী। কেন? কারণ মানুষ সব চাইতে অপছন্দ করে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে। সেই ক্ষেত্রে ভারত তো অগ্রগণ্য, সাথে আমাদের সহোদর দেশগুলোও। কারণ আমাদের যা কিছু চরম সত্য সব জানা হয়ে গেছে। এখন শুধু দাগের উপর দাগ বুলিয়ে যাও। তাতে কি হবে, নতুন চিন্তার দায়ভার নিতে হবে না। নিজের নিশ্চিত জীবনযাপনে কোনো সংশয়ের ভ্রুকুটি দেখা যাবে না। অগত্যা বোলাও দাগ।
আয়াপ্পা ও ব্রহ্মচর্য্য
=================
আয়াপ্পা হলেন বিষ্ণু আর মহাদেবের মিলিত সন্তান। এখন কথা হচ্ছে তিনি ব্রহ্মচারী কেন থাকতে চান? কারণ সকলের অভীষ্ট পূরণ করার জন্য আয়াপ্পার হাতে ওই একমাত্র পথ। এখন এই ব্রহ্মচর্যটা খুব পুরুষ ডমিনেটিং ব্যাপার। পৃথিবীর সব ধর্মের প্রধান মানুষটি যেমন পুরুষ, এও তেমন। মহিলার অবতার হয়ে পৃথিবী উদ্ধারের কথা শোনা যায় না। কারণ পৃথিবীর ঈশ্বরও পুরুষ। সেই আয়াপ্পার মন্দিরের বাইরে অপেক্ষা করছেন চিরকাল এক নারী যিনি এককালে রাক্ষসী ছিলেন, তার ইচ্ছা আয়াপ্পাকে বিয়ে করে। তো সেই নারীর প্রেমের প্রতি মর্যাদা রক্ষায় কোনো ঋতুবতী মহিলা সেখানে ঢোকেন না। তারা নাকি স্বেচ্ছায় যান না। যেমন পুরুষেরাই নাকি মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ক্লান্তি লাঘবের জন্য সব ধর্মীয় কাজ থেকে সরিয়ে রাখতে নানা নিয়ম করেছিল। অর্থাৎ যা কিছু নিয়ম তা দয়াবান পুরুষের হৃদয়জাত। আধুনিক মহিলারা তাতে লিঙ্গবৈষম্যের আঁচ পাচ্ছেন।
আসলে আমরা তথ্যের থেকে গল্প ভালোবাসি। সত্যের থেকে মনের মত রূপকথা। তাই হল কি সেই গল্পে কেউ অন্য রকম ধারা জন্মালে ক্ষেপে যাই। মনে হয় তা কেন হবে? আমরা কি তবে এতদিন ভুল ছিলাম? এখন কথা হচ্ছে যে, চিরটাকাল যে কেউই ঠিক থাকতে পারে না। 'ঠিক'টা যে পরিস্থিতির সাথে সাথে বদলে যায় তা কে কাকে বোঝাবে? আর বোঝাতে গেলেই তারা বুঝবেই বা কেন? আর যারা কথায় কথায় প্রশ্ন করে তারা তো আরো মুশকিলে ফেলে। কেন যে এত জানার ইচ্ছা, বিচারের ইচ্ছা? আরে আমরা তো সব বিশ্বাসকেই জায়গা দিয়েছি। সেই উদারতা তো আমাদের আছে। কিন্তু যুক্তির কথা আবার কেন?
এই ব্রহ্মচর্য্য এমনই একটা অদ্ভুত ধারণা, যা পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে। তার প্রধান ধারণ এই পদ্ধতিতে মানুষ শুদ্ধ থাকে। কি শুদ্ধ থাকে? তার শরীর, মন ইত্যাদি। কেন শুদ্ধ থাকে? কারণ যৌনতা অশুদ্ধ। তুমি জন্মালে কি করে? যৌনতায়। একমাত্র যীশু আর রামকৃষ্ণদেব নাকি বিনা যৌন মিলনে জন্মেছিলেন বলে দাবী করেন ভক্তরা। বাকি বুদ্ধ, নানক, কবীর, রামপ্রসাদ এদের যে বাচ্চাকাচ্চা ছিল? সে অন্য কথা। অর্থাৎ আবার গোলমাল। শুদ্ধতাটা তবে কি? কান্ট মহাশয় বলেন যা কিছু সদিচ্ছায় করা হয় তাই শুদ্ধ। নইলে কোনো কিছুই সেই অর্থে শুদ্ধ হয় না। বোঝো কার কথা কোথায় পাড়ছি। তো কথা হল শুদ্ধতা রক্ষা করতে হলে নির্যৌন থাকতে হবে। এ নিয়ে মহাত্মারও অনেক কথা ছিল। সে যাক। আমার ভয় খালি শরীর আর মনের এমন বিচ্ছেদে যদি কোনো মঙ্গল আশা করি, সে কি স্বাভাবিক? নাকি বুদ্ধির মধ্যস্থতায় শরীর আর মনের একটা মিল ঘটিয়ে চলাটাই স্বাভাবিক?
ভয় বনাম যুক্তি
==============
ঈশ্বর আর ধর্মের মূল উৎস ভয়। আমি প্রেমিকের কথা বলছি না। কবিতার ঈশ্বর অনেক উদার, বুঝদার। ধর্মের ঈশ্বর রাজনীতি বোঝেন মানবনীতির চাইতে বেশি। তো কথা হল যে এই ভয়ের দরজা ঠেলে কোনো নারী কি সত্যিই যাবেন মন্দিরে? কজন যাবেন? কাটবে এতকালের লালিত ভয়? যুক্তির কোনো ঐতিহ্য নেই। ভয়ের ঐতিহ্য হয়, ধর্ম হয়, সংস্কার হয়। কিন্তু যুক্তি চিরকাল একা। তার না অতীত, না ভবিষ্যত। তবে? সেই এত কালের লালিত ভয়ের শিকল ভেঙে কে যাবে সেই হল কথা। তবে আশার কথা কি, মানুষ বিশ্বাস না করলেও বুঝছে যে অন্ধতার ভিতটা নড়ছে। তাকে আর কালের দোহাই দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রাচীনত্বটা যে কোনো যুক্তি নয় সামনে নিয়ে চলার এটা স্পষ্ট হচ্ছে।
একটা বিশ্বব্যাপী চিরকালীন নীতি আছে - সাম্য। একের শাসনে জগত চলে - এই বিশ্বাস মানুষের যেদিন ভাঙল, সেদিন সে বলেছিল আমার ঈশ্বর সর্বভূতে, প্রতিটা অস্তিত্বের কণায় কণায়। এই ঈশ্বরের পূজো চলে না, এই ঈশ্বরের সাধনা চলে। সে সাধনা নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাধনা। তাতে আমরা যত শীঘ্র সফল হই তত মঙ্গল। সেই সাধনার ডাক রবীন্দ্রনাথের প্রাণে এসেছিল। তাই তিনি এত যন্ত্রণা বাইরে ভেতরে সহ্য করেছিলেন। সসীমে অসীমের ডানার ঝাপট। রবীন্দ্রনাথের কথা কেন বললাম? সবার বক্তব্য তো যুক্তি নির্ভর হয় না। এর হয়েছিল। কবি কল্পলোকে থাকবেন, সেই স্বাভাবিক, কিন্তু দেখা যায় ইনিই সেই সময় সব চাইতে বেশি মাটির কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলেন। কোন দল না গড়েই। সে অন্য কথা।