“বুঝিলাম, শচীশ এমন-একটা জগতে আছে আমি যেখানে একেবারেই নাই। মিলনমাত্র যে আমাকে শচীশ বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল, সে-আমি শ্রীবিলাস নয়, সে-আমি 'সর্বভূত'; সে-আমি একটা আইডিয়া।
এই ধরনের আইডিয়া জিনিসটা মদের মতো; নেশার বিহ্বলতায় মাতাল যাকে-তাকে বুকে জড়াইয়া অশ্রুবর্ষণ করিতে পারে, তখন আমিই কী আর অন্যই কী। কিন্তু এই বুকে-জড়ানোতে মাতালের যতই আনন্দ থাক্, আমার তো নাই; আমি তো ভেদজ্ঞানবিলুপ্ত একাকারতা-বন্যার একটা ঢেউমাত্র হইতে চাই না--আমি যে আমি।“
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটার মত এত গভীরে নাড়া আমায় খুব কম উপন্যাস দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের। ‘গোরা’ ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু মনস্তত্ববিদ্যা আর ধর্মবৃত্তির এমন মুখোশ খসানো লেখা, স্তম্ভিত করে দেয়। আমি ছোটবেলা থেকে যতবার ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ কথাটা শুনতাম কিম্বা ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর’, আমার কেমন সংশয় হত। মনে হত আমায় যে ভালোবাসে, হঠাৎ করে কোনো একদিন যদি জানতে পারি যে, সে আসলে আমায় ভালোবাসেনি, বেসেছে আমায় ব্রহ্ম জেনে, সেদিন কি আমার অপমান লাগবে না? লাগবে। আমি একটা মানুষ, আমি যা দাবীই করি না কেন, সে ভালোবাসাই হোক, কি করুণাই হোক, সে মানুষ হিসাবেই করি, কখনও তো নিজেকে ব্রহ্মের প্রতিভূ হিসাবে নয়!
তাই বারবার এই আইডিয়াটা থেকে নিজেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছি। কারণ এর মধ্যে একটা নেশা আছে। একবার এক ভক্তমণ্ডলী কম্বল বিতরণের অনুষ্ঠান করে গরীব মানুষদের জন্য। তারা কম্বল দেওয়ার আগে তাদের একটা চেয়ারে বসিয়ে কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে, হাতে ফুলের স্তবক দিয়ে, প্রণাম করে কম্বল হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। আমার ওই হতদরিদ্র চেয়ারে বসা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও খুব যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছিল। কেমন যেন আমাদের একটা খেলার নেশায় পেয়েছে। 'ভগবান' 'ভগবান' খেলা। ওরা আমাদের খেলনা। আজ কিছুক্ষণের জন্য ওরা ভগবান। ওদের অপ্রস্তত, সঙ্কুচিত আচরণ আমাদের ইগোকে কোথায় যেন একটা আরাম দিয়ে যাচ্ছে, ‘আমরাও কিছু একটা করছি’। আমার মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এভাবে যদি আমরা না দিতাম, আমাদের মনের ভাব মনেই রেখে, মানুষের স্বাভাবিক যে মর্যাদা সেই মর্যাদাটুকু দিয়েই যদি তাদের হাতে এই সামগ্রীগুলো তুলে দিতাম? তাতে কি খুব অসুবিধা হত? হত। আমাদের সুক্ষ্ম ভক্তের ইমেজটার যে ইগো সে আরাম পেত কি? যে মানুষগুলো সাধারণ মানুষ হওয়ার সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত, সে যদি হঠাৎ ব্রহ্মের সম্মানে ভূষিত হওয়ার যাঁতাকলে পড়ে, তবে সে নিতান্তই বিড়ম্বনা তার কাছে।
তবে আজ যে কথাটা এত সহজে লিখছি, সেদিন কিন্তু এতটা সহজে অনুভব করিনি একথাগুলো। বরং আমার মাথায় এমন বিপরীত চিন্তা আসার কারণে নিজেকে ভর্ৎসনাও করেছি। তবু যা সত্য বলে অনুভব করেছি, তা একদিন না একদিন তো বলিষ্ঠ হবেই নিজের সত্তায়। তাই-ই হয়েছে।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে আরেকটা কথা মারাত্মক লাগে। 'ননী' নামক মেয়েটিকে বাড়ির বড়ছেলে ধর্ষণ করে যখন গর্ভবতী করেছে ও বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, সে তখন নানা ঘটনার পর আশ্রয় পেয়েছে সেই বাড়িরই আরেক প্রান্তে জগমোহনের বাৎসল্যে। যে জগমোহন 'নাস্তিক' বলে সর্বজনবিদিত। সে খবর পেয়ে তাদের বাড়িরই একজন মহিলা এসে বলছেন, তুমি একি অনাচার করছ বাবা? ওকে বিদায় করো! তখন জগমোহন বলছেন, "তোমরা ধার্মিক, তোমরা এমন কথা বলিতে পার।"
এই লাইনটা চড়ের মত লেগেছিল। আজও লাগে। ক'দিন আগে টাইমসের এডিটোরিয়ালে পড়ছিলাম, বলা হচ্ছে, ‘ভারতের সময় এসেছে এবার ধর্মের কোন্দল ছেড়ে সামাজিক নানান সমস্যার হাল খোঁজার।‘ পড়ে হাসিই পেল। সময় এসেছে না, বহুদিন হল এসে বসে আছে। কিন্তু আমাদের সময় হলে তো!
ধর্মের আর ভালোবাসার মধ্যে একটা চুক্তি আছে। যেন ভালোবাসার চূড়ান্ত অভাব যাদের তারাই এই ধর্মের আশ্রয়ে নিজের একটা গতি খোঁজেন। কারণ ধর্মগ্রন্থে কিম্বা ধর্মসভায় যে পরিমাণ ভালোবাসার কথা লেখা আছে বা আলোচনা হয় আর কোথাও হয় বলে দেখি না। এইক্ষেত্রে ধর্মের দোসর অবশ্য রাজনীতি কিছুটা। সেখানেও প্রচুর সহমর্মিতা তথা ভাইচারা জাগাবার কথা আসে। কিন্তু মুশকিল হল এই দুই ভালোবাসাই বড্ড শর্তসাপেক্ষ। ধর্মের ভালোবাসার সীমা আছে। আর রাজনীতির ভ্রাতৃত্ববোধের একটা মরশুম আছে। রাজনীতি থাক। তবে সেখানে প্রায়শই দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবার এমন উতলা আবেগ দেখি, ভয় হয় যে, সত্যিই যদি পৃথিবী একদিন দারিদ্র্যমুক্ত হয় তবে এনারা না স্ব-অস্তিত্বসংকটে ভোগেন।
সে যাক, তবে ধর্মের এই ভালোবাসার অনুশীলনটা বড় ভয়াবহ লাগে। কারণ ভালোবাসাটা স্বাভাবিকভাবে না এলে তার গতি এত বিচিত্রপথে বইতে থাকে যে তার দায় সামলানো রীতিমত কঠিন। অবশ্যই তাতে মানুষের অনেক সেবা হয়। দুর্গতরা একটা আশ্রয় পায়। কিন্তু ক'জন? সমাজটা তো দয়ায় চলে না, দায়ে চলে – রবীন্দ্রনাথের কথা। সেই দায়বোধটা ধর্ম দিতে পারে না, দেয় নাগরিকত্বের বোধ। একটা বিশাল তন্ত্রের আমি একটা অংশ, আর পাঁচটা মানুষের থেকে কোথাও কোনো অংশে আমি ছোটো বা বড় কোনোটাই নই। সেই তন্ত্রে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমার একটা ভূমিকা আছে। সেটা সুচারুরূপে করে যাওয়াটাই আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচাইতে বড় কাজ, কিম্বা একমাত্র কাজ।
ধর্মের সমস্যা হল সে প্রেমের বাণী দেয়, প্রেম দেয় না। করুণার শিক্ষা দেয়, কিন্তু তার সাথে করুণার পাত্রকে সমান করে নিতে শেখায় না। যারা আমাদের আলোকিত পুরুষ তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কারণ তারা কোনো ধর্মে জন্মান না। মুশকিল হল তাদের থেকে ধর্ম জন্মায়। যীশু খ্রীষ্টান ছিলেন না, বুদ্ধ বৌদ্ধ ছিলেন না, নানক শিখ ছিলেন না। তারা তখনকার প্রতিষ্ঠিত ধর্মস্থান থেকে বরং দূরেই থাকতেন। ভালোবাসাটা তাদের বাণী ছিল না, শ্বাস-প্রশ্বাসের মত স্বাভাবিক ছিল। তারা বাণী দিয়ে মানুষকে জাগাতেন না, জীবনের ঊষ্মা দিয়ে জাগাতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শুধু বাণী আর জীবনটার মুকাভিনয়টুকুই থাকে, ঊষ্মাটা আর মেলে না। তাই যেটা পথ ছিল, সেটা গোল হয়ে ঘুরে পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায়। যেখানেই স্বাভাবিক জীবনের তাগিদের অভাব সেখানেই ধর্মের আয়োজন সবচাইতে বেশি। ভালোবাসা তখন ম্যানিফেস্টো। একদলের প্রতি প্রাণঢালা ভালোবাসা, কিন্ত দল বদলালেই ভালোবাসার গভীরতা আর দিক বদলে গেল। তখন সে শুধু করুণার পাত্র। তার প্রতি শুধু তখন ধার্মিকের কর্তব্যটুকু টিকে থাকে। বাইরের প্রাকৃতিক আলো নিভলেই ঘরের কৃত্রিম আলোগুলোর খোঁজ পড়ে, এও সেরকমই একটা কিছু বলা যেতে পারে।
তবে কি ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নেই? কথাটাই অবান্তর। যেন সংসারে যা কিছু প্রয়োজন তাই শুধু আছে। তা তো নয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ততেই সংসার উপচে পড়ছে। ধর্ম আছে আর থাকবেও, তবে সে প্রয়োজনের জন্য না, আমাদের ভয়ের আর অমরত্বের প্রতি আসক্তির জন্য টিকে থাকবেই। যেমন রূপকথা, যেমন ভুতের গল্প, যেমন সবাই সমান সম্পদের অধিকারী – ইত্যাদি ধারণারা এখনও টিকে আছে তার কোনো বাস্তব প্রমাণসূত্র ছাড়াই।
মানুষের সবচাইতে বড় মোহ বোধহয় নিজেকে বুদ্ধিমান জীব ভাবা। মানুষ আদতে যুক্তিপূর্ণ একটা সত্তা না তো শুধু। তাই সে শুধু প্রয়োজনের হতে পারে না। জামা যদি শুধু লজ্জা নিবারণের হত, তবে এত কুশলী কারিগরের দরকার হত না। কোনোমতে কাজ চললেই হত। পৃথিবীতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে যেত না যদি সে শুধুই যুক্তিনির্ভর সত্তা হত। আসলে সে মনোনির্ভর একটা সত্তা। যা শরীরের থেকে নিজেকে পৃথক ভেবে একটা অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে। যা তার মানসিক অস্তিত্ব। সেইটাই আসল তার কাছে। তার নিজের তৈরি ‘আমি’। তার সব পরিচয়টুকুই এই মানসিক বলয়ের মধ্যে। বাকিটা তো শুধু প্রয়োজনের ক্ষেত্র, যেমন পশুদের। তাই বলছিলাম আমরা বুদ্ধিমান সত্তা নই, মনোময় সত্তা। যে মন ভুলের আর ঠিকের একটা আজব সংমিশ্রণ। যতই আলো জ্বালো, অন্ধকারটাই অসীম হয়ে থাকবে। এরই মধ্যে রাস্তা খুঁজে চলা, আদৌ যদি তা রাস্তা হয় তো।
এর মধ্যে সুখ বলতে এই এক চিলতে শীতের রোদের মত কামে-আবেগে-স্নেহেতে-কান্নায়-আবদারে জড়িত ভালোবাসা। ধর্ম যার মুখোশ বেচে, আর প্রতিদিনের সংসার যা চালের মত বুকে ফুটিয়ে ভাত রাঁধে। সে ভাতের ফ্যানেও কোনো কোনো জীবন চলে যায়। কারণ সে ফ্যানটুকুও খাঁটি। মুখোশ অন্তত নয়।