সৌরভ ভট্টাচার্য
25 December 2016
আজ যে মহাপুরুষের জন্মদিন তিনি একটা খুব বড় কথা বলেছেন, নিজের ভিতর ঈশ্বরের রাজ্য অন্বেষণ করো, বাকি সব কিছু তোমায় আপনা থেকেই আসবে। আবার বলছেন সে পথের দ্বার অত্যন্ত শীর্ণ। আবার বলছেন এক শুঁড়িখানায় দাঁড়িয়ে, একটা শিশুকে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে, যতক্ষণ না এই শিশুটার মত সরল হতে পারছ সে রাজ্য থেকে তুমি অনেক দূরে।
এডওয়ার্ড সাহেব বুদ্ধের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছেন, আপনারা যদি মনের করেন যীশু আপনাদের নিজস্ব ধর্ম আর বুদ্ধ নন কারণ তিনি পূর্বের, তবে ভুল করছেন, আপনাদের ধর্মের সূত্রপাতও সেই পূর্ব দিক থেকেই শুরু হয়েছিল।
পাশ্চাত্য দর্শনে একদিন নীতি, সমাজ, কর্তব্য ইত্যাদি নিয়ে প্রবল আলোচনা হয়েছিল। বেশ বড় একটা যুগ ছিল সেটা। ক্রমশঃ আরেকটা মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গী দেখা দিল পাশ্চাত্য সাহিত্য তথা দর্শনে – নঞর্থক বাদ। সে জটিল দর্শনের মূলে কোথাও একটা বিষাদের সুর আসে। দস্তইয়েভেস্কি (যদিও রাশিয়ান), কাফকা, জিদে, সাঁত্রে, নিৎজে ইত্যাদিদের লেখায় কোথাও একটা বিষাদের সুর। সবই আছে তবে আমরা যেভাবে সবকিছুকে নিজেদের মত অর্থযুক্ত ভাবি ঠিক সেভাবে তারা অর্থযুক্ত নয় – এই বোধটা চূড়ান্ত হতে শুরু করে লেখায়। কঠোর বাস্তববাদ, অস্তিত্ত্ববাদ, ইহলোকবাদ ইত্যাদি নানান দর্শনে একটা ‘নেই নেই’ ভাব, একটা শূন্যতার দিকে ইঙ্গিত। সব শূন্য জেনে কোথাও একটা বিশ্রাম নেওয়ার কথা। যদিও এ আপামর পাশ্চাত্যবাসীর মনোদর্শন না। তাহলে তারা এত কর্মমুখী হয়ে উঠতে পারত না কখনোই। এ তাদের এক প্রকার চিন্তার রাজ্য। ভাবনার ক্ষেত্র। এই বিষাদ জীবনের গভীরে যে নেই তা নয়। আছে বলেই তাকে ঢাকতে এত উচ্ছ্বাস বাইরে। এত উত্তেজনা এত মাদকতা। আজ যা আমাদের সমাজের উপর ছেয়ে আসছে।
আমাদের দেশে কি তবে এই নঞর্থক দর্শন ছিল না? দর্শনের কথা থাক, জীবনের উপর এ রকম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল না? ছিল। আমরাও ভেবেছি শূন্যতার কথা, জগতলীলার অন্তঃসার শূন্যতার কথা, জীবনের ক্ষণিক অস্তিত্বের কথা। বিষাদ এসেছে। তবে বিষাদেই থেমে থাকতে চাইনি। তার জায়গায় এসেছে আরেকটা শব্দ – বৈরাগ্য। ‘অর্থহীন সব কিছু’ এই শেষ কথা না, এর পরের কথাটাও বুঝতে হবে। আরো এগোতে হবে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ, রামপ্রাসাদ সেনের একটা গান উল্লেখ করে বলছেন, অনুভবের আগে এ সংসার ধোকার টাটি, অনুভবের পর এই সংসারই মজার কুটি। রামকৃষ্ণদেব আরো বলছেন, এগিয়ে পড়ো, এগিয়ে পড়ো, এগিয়ে পড়ো। বিশ্ব সংসারে ছলনার জাল নেই তা তো নয়, কিন্তু সে ছলনাকে বোঝার মত বোধও তোমার ভিতর আছে, ঠকাতে চাইলেই ঠকবে কেন? বোধের সেই ক্ষমতাই তোমায় দেবে তোমার বৈরাগ্য - ‘প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, প্রবৃত্তিরে সঙ্গে লবি/ ওরে বিবেক নামে তারই বেটা তত্ত্বকথা তায় শুধাবি’। একটু রাশ টানো না গো, দেখো না একবার ভিতরের চোখদুটো মেলে, সব বুঝতে পারবে। কোথাও বনে বাঁদাড়ে ঘুরে মরতে হবে না, কোনো গুহায় গিয়ে গিয়ে ছাইভস্ম মেখে বসতে হবে না, শুধু অন্তঃকরণটা শুদ্ধ করো। কাঁদো, কাঁদো। অবিশ্বাসী কাঁদে না। জ্বলে মরে। সে জানে না কাঁদতে কাঁদতেই বিশ্বাস জন্মায়। কাঁদতে কাঁদতেই ছুঁচের উপরের কাদা ধুয়ে যায় আর তখনই চুম্বক তাকে টানে। ওগো শুধু এই কথাটা বলব বলেই আমার আসা, মা আমাকে পাঠিয়েছেন শুধু এই কথাটুকু তোমাদের জানাতে হবে বলে, তোমাদের একজন মা আছেন বোঝাতে, যেমন সেই লোকটা জেরুজেলামে এসেছিল তোমাদের একজন পিতা আছেন বোঝাতে। সেই পিতাই আমার এই মা, সেই মা-ই মহম্মদের আল্লাহ্। সেই মা-ই বুদ্ধের বোধস্বরূপ হয়ে পরম বোধ- নির্বাণ। তিনি আরো কত কত কি তিনিই জানেন। তোমার অত না জানলেও চলবে, হ্যাঁ গা এক সের দুধের ঘটিতে কি আর চার সের দুধ ধরে? আর তোমার যদি এক বোতল মদে নেশা হয়ে যায়, তবে শুঁড়িখানায় কত মদ আছে জানার কি দরকার?
এই হল আমাদের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা। পৃথিবীতে এতবড় মাপের দার্শনিক এর আগে এসেছিলেন কিনা আমার অন্তত জানা নেই। তিনি বলছেন, তবে মর্কট বৈরাগ্য না, শুষ্ক বৈরাগ্য না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, গাছ ফলের ভারে আপনি নুয়ে পড়ে সেই সত্যকারের নম্রতা। এই হল সত্যকারের বৈরাগ্য। ‘বাহিরের এই ভিক্ষা ভরা থালি এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি/ অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে প্রভু তোমার দানে তোমার দানে তোমার দানে’
এই হল কথা। এ নিজেকে ছাপিয়ে নিজেকে মেলে ধরার কথা। খুব কঠিন কথা? না কঠিন কথা না, খুব বড় কথা। আকাশের মত কথা। সমুদ্রের মত কথা। জীবনকে ভরিয়ে তোলার কথা। খানদানী চাষা হওয়ার কথা। ‘এমন মানবজমিন রইল পড়ে আবাদ করলে ফলত সোনা’ । বিষাদ না, বৈরাগ্য। পরীক্ষার আগে যেমন সব দিক থেকে মন তুলে নিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়, সেকি শূন্যতার জন্য? না না না। সে পরীক্ষার ফলের দিকে তাকিয়ে এই কঠোরতাকে স্বীকার করে নেয়, শিক্ষকের কথায় বিশ্বাস করে।
ভিতরের জগতের পরীক্ষক আর ছাত্র দুই আমি। নিজেকে ফাঁকি দিলে নিজের ফাঁকি, নিজেকে ভরিয়ে তোলার সাধনায় দীক্ষা নিলে, নিজেই পূর্ণ। আজকে সেই দীক্ষা নেওয়ার দিন।
ছবি - ইন্টারনেট