ব্যক্তি ও নীতি। এ দু'জনের সম্পর্ক কি? দু'জন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্কে নীতির থেকে আবেগ, ব্যক্তিগত ভাল লাগা, মন্দ লাগা, সুবিধা অসুবিধার গুরুত্ব অনেক বেশি। অন্যদিকে ব্যক্তির সাথে যখন সমষ্টির সম্পর্কের কথা আসে তখনই নীতির প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গও এসে পড়ে। পারিবারিক নীতি, ক্লাবের নীতি থেকে শুরু করে ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি। নীতি অর্থে 'বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়' পরীক্ষিত নিয়মাবলী। নীতিই পারে বহুকে একটি নির্দিষ্ট দিকে, নির্দিষ্ট উদ্দ্যেশ্যে পরিচালিত করতে। এই নীতির প্রস্তর থেকেই সভ্যতার ভিত স্থাপন। সত্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি কোনো ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের দৃষ্টিতে তৈরী হয়নি। এগুলো সার্বিক সভ্যতার বিকাশের মেরুদন্ড। প্লেটো তাঁর কালজয়ী 'রিপাবলিক' গ্রন্থে বলেন, মানুষ তথা সমাজের মূল চারটি ভিতের কথা- সাহস, প্রজ্ঞা, সংযত আচরণ ও ন্যায়পরায়নতা। অন্যদিকে লোকধর্মের মূল সূত্রের আলোচনা করতে গিয়ে ব্যাসদেব বলেন, 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়' তত্বের কথা। এই নীতিই ব্যক্তি মানুষের চিত্তে সমষ্টির সাথে যুক্ত হওয়ার আকুতির বাস্তবায়িত পথ।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আমরা কি নির্ভুল সমাজনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি আবিস্কার করে ফেলেছি? তার উত্তর, না। জীবের দেহের, মনের ক্রমবিকাশের মত নীতিরও ক্রমবিকাশ হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। তাই কালের সাথে সাথে নীতিরও পরিমার্জন, পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমবিকাশ চলেছে। ইতিহাস সাক্ষী। তাই কোনো নীতিই সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত, ধ্রুব নয়। এমনকি আমাদের গণতন্ত্রও না। যখন কোনো ব্যক্তিতে বা জাতিতে কোনো নীতিকে ধ্রুব বলে মানার প্রবণতা দেখা গিয়েছে তখনই তার মধ্যে একটা স্থবিরতা এসেছে, জড়তা এসেছে। ইতিহাসে এর প্রমাণও বহু মিলবে।
তবে উপায়? উপায় হল উন্নত'তম' না পাই 'তর' তো পাই। তাকে অনুসরণ করা যা আরো বেশি আলোকিত বিজ্ঞানের আলোকে অথবা উদারতার জ্যোতিতে।
নীতির প্রথম শর্তই হল, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রস্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠতে হবে। আমি সমাজের যত উচ্চ ক্ষমতায় আসীন আমার ত্যাগকে তত মহৎ হতে হয়। কারণ নীতির ক্ষেত্র যত বৃহৎ, তার সাথে জড়িত সমষ্টির স্বার্থও তত বৃহৎ। আমি একটি পরিবারের প্রধান হলে যে আত্মত্যাগ করতে হয়, পাড়ার উন্নয়ন কমিটির প্রধান হলে আত্মত্যাগের পরিমাণ আরো বেশি হয়। আর রাজ্যের বা দেশের প্রধান হলে? সহজেই অনুমেয় কি সজাগ সতর্ক হওয়া উচিৎ তাঁর প্রতিটা আচরণকে। প্রধান মানেই নীতির রক্ষার ভার তাঁর উপরে ন্যাস্ত।
কিন্তু দেশের যিনি প্রধান তিনি যদি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে নীতির ঊর্ধে স্থান দেন, দলীয় নীতিকে জাতীয় নীতির ঊর্ধ্বে বসান, নীতির ঊর্ধ্বে নীতিধারক হয়ে ওঠেন তখন তা আর যাই হোক গণতন্ত্র থাকে না। সেই স্বৈরতন্ত্র বা ব্যক্তিতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, লাভ-লোকসানই মূল নির্ধারক বা মাপকাঠি। কোনো ঘটনাকেই আর সমষ্টির স্বার্থে ভাবা সম্ভব না। কোনো বিশেষ ব্যক্তির, বিশেষ পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে বাধ্য করার প্রচেষ্টা চলে। স্তাবকের দল অগ্রগণ্য হন। নিরেপক্ষ দল অত্যাচারিত হন, বিরোধীদল নির্বাসত হন। এর উদাহরণও কালকের অধুনা প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে সূদুর ইতিহাসের পাতায় পাতায় সাক্ষ্য বহন করে আসছে।
এর পরিণাম? সে তো সকলেরই জানা। 'অতি দর্পে হর্তা লঙ্কা'। শুধু সময়ের অপেক্ষা। স্তাবক আর স্তাব্য কেউই কালের গতিতে চিরস্থায়ী হতে পারেন না। চিরস্থায়ী নীতিই হল- 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়'।