বৃষ্টির জল রেনপাইপ দিয়ে নামবে, না হাঁ মুখ সিংহ দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়বে? আজকাল হাঁ মুখ সিংহ আর দেখি না। নৈহাটিতে আগে বেশ কিছু পুরোনো বাড়ির ছাদে দুটো তিনটে করে হাঁ মুখ সিংহকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। তাদের বাকি শরীরটা ছাদে মিশে। মানে নেই আরকি। শুধু মুখটাই ছাদের বাইরে বার করা। শুকনো খটখটে আকাশে বোঝা যাবে না ওদের কি মহিমা। যেই না বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, অমনি দেখা যাবে প্রথমে সরু হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে বড় মোটা জলের ধারা হুড়মুড় করে মাটিতে এসে পড়ছে।
এখন রেনপাইপ। ছাদের জল সবার অলক্ষ্যে সোজাসুজি ড্রেনে গিয়ে নালায় গিয়ে মিশছে। কেউ জানছে না কোন ছাদ কত জলে বর্ষায় ভিজছে। বর্ষার সময় নালার দিকে তাকিয়ে আর কে বসে থাকে? কিন্তু ওই দেওয়াল বেয়ে নামা কালো, ধূষর পাইপগুলোকে দেখো, ওরা জানতেই দিচ্ছে না কোন ছাদের সাথে বর্ষার কিরকম বোঝাপড়া চলছে।
আসলে আমাদের সভ্যতার উন্নতির সাথে কোথাও একটা ঢাকাঢাকির সম্পর্ক আছে। মাঝে মাঝেই বাড়ির পাশ দিয়ে যখন ফেরিওয়ালা “টিভির কভার... আলমারির কভার... কম্পিউটারের কভার... গাড়ির কভার...” ইত্যাদি ইত্যাদি হাঁকতে হাঁকতে চলে যায়, ভাবি মানুষ কিছু বানাতে না বানাতেই কেমন তাকে ঢেকে মুড়ে ফেলার প্রবণতা আপনিই জন্মে যায়। আগে ‘টেলিফোনের কভার’ চীৎকার করতে করতেও যেত, আজকাল আর বলে না। ওরাও জেনে গেছে সেই ল্যাণ্ডফোনের যুগ আর নেই। বড্ড ধুলো চারদিকে। কারা বানায় এত ধুলো, কেউ জানে না।
এই ঢাকাঢাকি অবশ্যই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। কিন্তু কতদূর অবধি? অনেকদিনের ঢাকা বস্তুর নীচে কত ময়লা, ছত্রাক জন্মে যায় এও তো দেখেছি। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, যত উন্নত সভ্যতার জীব হচ্ছি, তত ঢাকাঢাকি অভ্যাসটা মনের উপরেও চারিয়ে দিচ্ছি। সব সময় “ভালো আছি” মনের আগেই জিভ বলে দেয়। মনের উপর জিভের আস্তরণ। সে কি ভালো? মনের মধ্যে যা ওঠে তারই প্রকাশ ভালো নয় যদিও, সে হলে যে ‘তুর্কিনাচন’ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা সে কথা তো রবীন্দ্রনাথ বলেইছেন। কিন্তু তবে ‘বাক্য যেথা হৃদয়ের উৎসমুখ হতে’ এই কথাটার কি হবে? মনের উপর জিভের চাদর বিছিয়ে চলাটা কি খুব স্বাস্থ্যকর? এই যে যখন শুনি যে পাশের বাড়ির মানুষটা বা পাশের বাড়ির স্বামী-স্ত্রী ভীষণ হাসিখুশী ছিলেন, লকডাউনের পর থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, যদিও ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে গেলে রাস্তায়, হেসে বলতেন “ভালো আছি”, তারপর একদিন গলায় দড়ি দিয়ে দিল – এ কি ভালো কথা? নয় তো। যদি দুঃখের, সমস্যার সত্যগুলো ভাষা না পেয়ে শুধুমুধু জিভের তলায়, হাসির তলায় চাপা পড়ে থাকে, তবে বিষাক্ত রস মনের মধ্যে চারিয়ে যায় না? আত্মহত্যা করতে কে চায় – শরীর না মন? অবশ্যই মন। শরীরের মৃত্যুর কথা ভাবলে সব সময়ই কষ্ট হয়, আতঙ্ক হয়। কিন্তু সে কি করবে, সে তো মনের অনুগামী। মন চায় আত্মহত্যা করতে। জিভের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটা কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভদ্রসমাজ। সেই গালিবের কথা ভাবা যাক – “দিলে নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়/ আখির ইস দর্দ কা দাওয়া কেয়া হ্যায়... ম্যায় ভি মু মে জুবান রাখতা হুঁ/ কাশ পুছো কি মুদ্দা কেয়া হ্যায়”... সেই জিভের সাথে মনের কথার অভিমান। আসলে এত ভালো ভালো পজিটিভ ভাবের কথার মধ্যে সে কি করে নিজের সমস্যার কথা বা কষ্টের কথা বলে বসে। কষ্ট তো ব্যক্তিগত, সুখ নয়। সুখ সুগন্ধ। দুঃখ কোলাব্যাঙের মত। ঘরের কোণে, অন্ধকারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে।
তবে এই মনের ঢাকাঢাকি স্বভাবটা বেশিদূর অবধি ভালো নয় বলুন? সবাই অবিশ্যি এমন নয়। এই তো গেল বছর গরমকালে, এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছি। বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি। চারদিকে একটুও ধুলোবালি নেই। বাথরুমের মেঝেতে জল নেই। চেয়ারে সোফায় ডাইনিং টেবিলে একটুও ধুলোবালি নেই। বেশ একটা পরিপাটি ব্যাপার। তা আমার সেই বন্ধু আবার ভীষণ সাহিত্যরসিক। আমরা বেশ কাব্য আলোচনা করছি। কাব্যে মেঘ আসছে। কারণ বাইরের আকাশে মেঘ জমেছে। বর্ষার কবিতার আলোচনা প্রায় মেঘদূত অবধি পৌঁছিয়েছে, হঠাৎ দেখি আমার সেই সাহিত্যরসিক বন্ধুটি কেমন উসখুস করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ বেশ প্রমাণ সাইজের একটা ঝাঁটা হাতে কিসের জন্য যেন তৈরি। ধপাধপ জানলা দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না হঠাৎ কি হল? আমার পাশে বসা আরেক বন্ধু, যিনি সংসারজীবনে যথেষ্ট অভিজ্ঞ, আমায় শান্ত নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল, “ঝড় আসছে, তাই ধুলো না ঢোকার প্রাক প্রস্তুতি চলছে।“ বুঝলাম। ভাবের চেয়ে ধুলো বাস্তব, একি আর বুঝি না!
সত্যিই ওদিকে ততক্ষণে ঝড় শুরু হয়ে গেছে বাইরে। আমার আবার ঝড়বৃষ্টি বিদ্যুৎ ঝলক দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু কি করি, কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইলাম। মনের মধ্যে কাব্যের আরশোলা ফড়ফড় করে কখনও এ কবি, সে কবির কবিতায় গিয়ে বসছে। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হল। আহা, মনের মধ্যে মল্লারের সুর যেন ধোপাবাড়ির পিটনির মত পাঁজরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। হয় তো আমার এই করুণ মুখচ্ছবি আমার ঝাঁটা হাতে বন্ধুটির প্রাণে কিছুটা দয়ার সঞ্চার করল, সে একটা দরজার পাল্লা খুলে দিয়ে বলল, শান্তি?
শান্তি বলে শান্তি। কিন্তু ইহজাগতিক সুখ আর কাব্যের সুখ তো এক নয়। হুড়মুড় করে ধুলো সেই প্রস্তরীভূত মেঝের উপর ঝাঁপ দিয়ে রে রে করে পড়ল। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। না, ঝড় এলো না বটে বন্ধুপক্ষ থেকে, বুঝলাম তার বেজায় কাজ বাড়ালাম। সে নিশ্চয় মনে মনে ভাবছে, নিজের তো কামকাজ নেই, অকাব্যিক সংসারের নানা খুঁটিনাটি পরিপাটি করে সামলিয়ে যদি ওসব দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে লোফালুফি খেলতিস তো বুঝতাম, সে তো করবে না... মাঝখান থেকে আমার কাজ বাড়িয়ে...
যা হোক, যে কারণে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, সবাই যে মনের উপর জিভের ঢাকনা দেয় না সেইটা বোঝানোর জন্যেই। কিন্তু সেও কি দেয় না, দেয়। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা সবাই মনের উপর বাজার থেকে বহুমূল্যে কেনা চলতি ফ্যাশানের জামা পরিয়েই বাইরে বার করি তাকে। সেই রীতি যে।
সবার দৃঢ় বিশ্বাস, এটা না হলে আমাদের সমাজ টিকবে না। আমাদের মনকে আবৃত করতেই হবে। মনকে এমনভাবে আবৃত করতে শিখতে হবে যে মন যেন জামা পরতে বায়না না করে। আমার বলার আগেই যেন সে অবস্থা বুঝে মাথার মধ্যে রাখা আলমারি খুলে, পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, বা সামাজিক শিক্ষা অনুযায়ী, বা একটা আন্দাজ অনুযায়ী জামাটা গলিয়ে ফেলে। আমাকে যেন অপ্রস্তুত না করে। এর ফলে কি হল, যে প্রচণ্ড হিংসুটে সেও প্রচণ্ড ভালোবাসা, কি উদারতার জামা পরে ফেলল। যে ভীষণ দুর্বল সেও একটা প্রকাণ্ড গ্ল্যাডিয়েটারের জামা কিনে পরে ফেলল, যতই তার পোশাকের চাপে প্রাণ গলার কাছে এসে ত্রাণের রাস্তা খুঁজুক না কেন। এরকম উল্টোপাল্টা জামাপরা অভ্যাস আমাদের এমন হয়ে গেছে যে, মনে হয় যেন ঘুম থেকে উঠেই ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ এ যাওয়ার তোরজোড় শুরু করে দিতে হচ্ছে। আমি আমাকেও বিশ্বাস করি না, আমি তোমাকেও বিশ্বাস করি না। আমার আমি, সে আমি থেকে তোমার পছন্দের আমি, তোমার পছন্দের আমি থেকে অমুকের পছন্দের আমি, অমুকের পছন্দের আমি থেকে তমুকের পছন্দের আমি... আবার কখনও কখনও আমার দুই হাতে দুই মানুষের পছন্দের আমি। মাঝে মাঝে এরকম নানা মানুষের পছন্দ অনুযায়ী আমিগুলোর ফেলে যাওয়া আবর্জনার মধ্যে থেকে জন্মায় খিটখিটে, বিরক্ত খেঁচুটে আমি একটা। কাউকে সামনে দুর্বল পেলেই তার গায়ে দুটো আঁচড় টেনে দিতে পারলে যেন তার গ্রীষ্মের দুপুরে গড়ের মাঠে বসে কোল্ডড্রিংক্স খাওয়ার সুখ।
তারপর সারাদিন নানা মানুষের নানা পছন্দের ক্ষেত চষে এসে ক্লান্ত শরীরে যখন বিছানায় যাচ্ছি তখন আমার আসল আমি ঘুমিয়ে কাদা। হবে না? সারাদিক কেউ ডাকেনি যে তাকে! তার নামই বা মনে আছে আজ কজনের? আমারও আর তাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না, ঘুমন্ত আমার আমির দিকে তাকিয়ে আমার এই চতুর বিষণ্ণ পরিণত আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে দেখি সেখানেও কত রকম পোশাক নিয়ে কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দরদাম করছি। ডিল করছি। সব স্বপ্নগুলোও বিক্রি হয়ে গেল কবে? জানতেই পারলাম না!