Skip to main content

ইউনিভার্সাল ভালোবাসার কোড বলে কিছু হয় না। ভালোবাসা ভীষণভাবেই আর পাঁচটা অনুভবী অস্তিত্বের মত আর্থসামাজিক আর ভৌগোলিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত। আমি 'ভালোবাসা' শব্দটা রোজকার ব্যবহারের অনুষঙ্গে বলছি। ভালোবাসা মানে যদি করুণা হয়, তবে সেটা ইউনিভার্সাল। সে অন্য প্রসঙ্গ।

ভালোবাসার ফাণ্ডামেন্টাল দিকটার অনুভব তাত্ত্বিকভাবে এক থাকলেও, বাস্তবিকভাবে তার প্রকাশ, তার আশা-আকাঙ্খা ভীষণভাবেই আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক। সমাজ বদলায়। অর্থনৈতিক অবস্থা বদলায়। ভালোবাসার প্রকাশও বদলায়। প্রত্যাশাও বদলায়। তবু প্রতি বছর শুনি, আগে সব ভালো ছিল। দিন যত যাচ্ছে, খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা বড্ড শারীরিক হয়ে যাচ্ছে নাকি। কথাটা আংশিকভাবে সত্যি।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষের উপর যখন আকর্ষণ অনুভব করছে, 'ভালোবাসা' অনুভব করছে, সেখানে কি শরীর নেই? আসলে এই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক - এই বিভাজনগুলোই ভীষণ গোলমেলে। ওভাবে ভাষায় আলাদা করা যায়, বাস্তবিকভাবে অনুভবে আলাদা করা আদৌ কি সম্ভব?

একটা সহজ ইকুয়েশন অনেককে টানতে দেখেছি, 'ইনফ্যাচুয়েশান' মানে শারীরিক টান শুধু। আর 'আসল ভালোবাসা' হল ভীষণ পবিত্র। মানে শরীরগন্ধরহিত।

বাস্তবিক সত্যি কি তাই? তবে 'কম্প্যাটিবিলিটি' কথাটার মানে কি? আমার সঙ্গে যদি তোমার কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক যায়, তবে আমার ইনফ্যাচুয়েশান থেকে দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসায় উন্নীত হতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু যদি কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক না যায়, তবে একে ওকে তাকে, ভাগ্যকে, বিধাতাকে দোষারোপ করে, হাজার একটা তত্ত্ব খাঁড়া করে আসল সত্যিটাকে ঢাকার কোনো মানেই হয় না। যেখানে কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক, সেখানে শরীর মন আত্মা মিলেমিশে সঠিক অনুপাতে দাঁড়ায়। আসলে আমার মধ্যে এইসব বিভাগগুলোই কাল্পনিক, ভাষা দিয়ে তৈরি করা যায়, কিন্তু বাস্তবে সবটা মিলিয়েই এক অখণ্ড, ইনডিভিসিবল অস্তিত্ব।

এখন এই কম্প্যাটিবিলিটি যাচাই না তো হাতের রেখা মিলিয়ে হয়, না তো মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী এই জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে এই জাতীয় চরিত্র যায় ইত্যাদি তত্ত্বে করা যায়। জলে না নেমে সাঁতার শেখা যেমন যায় না, এ ক্ষেত্রেও তাই। ভুলের মাধ্যমে ঠিকটা চিনতে হয়। এখন যে সমাজ এই ভুল শোধরানোর সুযোগ যতটা দেয় সেখানে সম্পর্কের সত্য হয়ে ওঠা ততটা হয়, নইলে "আগে সব ভালো ছিল, এখন সব বাজে" এইসব বলে দিন কাটাতে হয়। মেয়েদের দারুণ একটা শিক্ষা দেওয়া হয় না, "যাই হোক মুখ বুজে সহ্য করে নিবি, মেয়েমানু্ষের অত চাহিদা, ইগো থাকতে নেই" ইত্যাদি। এখন দেওয়া হয় না এ ভুল যেন না করি, এখনও দেওয়া হয়, তবে কিছুটা আগের চাইতে কম। তবে ততটা কম নয় যতটাতে স্বস্তি পাওয়ার মত কিছু আছে।

এখন এই কম্প্যাটিবিলিটি কথাটাও ভীষণ বায়োলজিক্যাল। মানে শারীরিক আর আবেগগত, দুই দিক থেকেই এর একটা সামঞ্জস্য হয়। যদিও বাংলা সিনেমায় এক অভূতপূর্ব পরিচালক জুটির দেখা মিলেছে আজকাল, যাদের সিনেমায় সমকামী পুরুষের সঙ্গেও নাকি এক বিপরীতকামী নারীর সহাবস্থান হতে পারে দেখায় তারা, স্বামীর সব দুষ্টুমি "একটু সহ্য" করে নিলেই সুখের সংসার গড়া যায় দেখায় তারা। তারা যে করে হোক দর্শককে খানিক সুড়সুড়ি দিয়ে সব গিলিয়ে দিতে চায়।

সে কথা থাক। কথাটা হল, এই "কম্প্যাটিবিলিটি' শব্দটা জটিল। বেজায় জটিল। দুয়ে দুয়ে চার করার মত নয়। এর কাছাকাছি একটা শব্দ আছে, কম্প্রোমাইজ। তাই দিয়েই সংসারের সিংহভাগ চলছে। তবু আমাদের আকাঙ্খা থাকে সম্পূর্ণ কম্প্যাটিবিলিটির। মনে হয় আজ না হয় কাল আসবেই। কিন্তু সে আমাদের অতৃপ্ত আবেগের কল্পনা। কারণ যত বোধ পাকা হয়, তত বোঝা যায় সংসারে আমার সঙ্গে শতাংশে কম্প্যাটিবিল হওয়ার মত একজনই আছে, সে আমি। এ বোধ যত বাড়ে মানুষ তত একা হয়, তবে সে একাকীত্বের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যায় ইতিমধ্যে। কিন্তু এ অন্য প্রসঙ্গ।

কিন্তু তবু কম্প্যাটিবিলিটি শব্দটা বাস্তব। কেন বাস্তব? কেউ কারোর গোটাগুটি মনের মত হয় না। সেটাকে কম্প্যাটিবিলিটি বলেও না। সেটা একটা ইউটোপিয়ান ধারণা। কম্প্যাটিবিলিটি মানে যার সঙ্গে চলা যায়। সহাবস্থান দু:সহ হয়ে ওঠে না।

আজকাল নাকি মানুষ ভীষণ শরীরের কথা বলছে। ভীষণ কামগন্ধ নাকি সর্বত্র।

কথাটা অবশ্যই আংশিক সত্য। আগে ছিল না, এখন আছে, তা নয়। আগে বলার মত পরিবেশ ছিল না, এখন আছে। সেদিন শুনলাম এক মেয়েদের স্কুলে, একজন ইলেভেনের মেয়ে একজন নাইনের মেয়েকে প্রেমপত্র লিখেছে বলে তাকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে। ঘটনাটা বিপরীত লিঙ্গে ঘটলে কি ঘটত? 'স্বাভাবিক' ঘটনা বলে হয় তো মেয়েটা এতবড় শাস্তি পেতো না, তার কাউকে ভালো লেগেছে বলে। এরপর থেকে মেয়েটা হয় তো এক 'বিশুদ্ধ ভালোবাসার' প্রকাশ ঘটাবে। নিজের স্বাভাবিক অনুভবকে চেপে সামাজিক অনুভবের অনুকরণ শিখে নেবে। এবং নিশ্চয়ই তার "শিক্ষা সম্পূর্ণ" হবে।

ভালোবাসা মানে কি শরীর? না। ভালোবাসা মানে শরীর সর্বস্বও নয়, ভালোবাসা মানে শরীর বিবর্জিতও নয়। দুই সত্য। প্রথম সত্যিটাকে দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করা হয়েছিল বলে আজ সে তার শোধ তুলছে সে সুদে আসলে।

আমাদের শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে আমাদের পবিত্রতা বোধ অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে। এখনও আমরা বলি, শিশুর মত পবিত্র। আরে ভাই পিটুইটারি পুরো মাত্রায় সজাগ হয়নি বলেই সে না এরকম? আসলে পিটুইটারি জেগে উঠলে শুধু যে "কোন্ মহা রাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি" হয়, তা তো নয়! "অঙ্গে অঙ্গে বাঁশি" বাজালে শুধু কথা ছিল না, তার সঙ্গে অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায় যে। সাইকেল শিখে নিজের বাড়ির উঠানে নিশ্চিন্তে চালানো আর ভরা বাজারের মধ্যে চালানোয় পার্থক্য তো আছেই না? সেই ম্যাচিউরিটি যদি ব্যক্তিত্ব না জন্মায় তবে ভালোবাসা শরীরে জাগলে অবশ্যই এক অশান্তি লাগে। যেখানে সমাজে আদর্শ ভালোবাসা নাকি হৃদয়ে জন্মিয়ে আর কোথায় চারায় না। চারালেই সে পাপ। এতো মহামুশকিল!

আজ সে বেড়া ভাঙছে। এখন প্লাবন হবেই। এত তাড়াতাড়ি সামঞ্জস্য চাইলে হবে কি করে? দাঁড়াও রে ভাই। অপেক্ষা করো। আগে থিতোক সব। আপসেই সব আবার সামঞ্জস্যে গিয়ে দাঁড়াবে। কোনো ধর্মনেতা, কোনো অনুশাসন, কোনো প্রবল আইন মানুষের প্রাণের গতিকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। যেখানেই সে তা করতে গেছে সেখানেই সে জন্ম দিয়েছে বিকৃতির। পার্ভাশানের।

আধুনিক প্রজন্মের ভালোবাসার প্রকাশে শরীরের ভাষা জাগছে। জাগুক। নিজেকে স্পষ্ট করে চিনুক। বুঝুক। তাকে সঠিক জিনিসটা না শিখিয়ে কিছু প্রাচীন নীতিমালা শিখিয়ে লাভ নেই। বরং তাকে বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষিত, সুস্থ যৌনশিক্ষা দেওয়া হোক। এক্সপ্লয়টেশান শুধু তো শরীরের হয় না, ইমোশান নিয়েও হয়। তাই সব দিক থেকে নিজেকে একজন কিভাবে সুরক্ষিত রাখবে, সুস্থ রাখবে সে শিক্ষাই দেওয়া হোক। যৌনরোগ ইত্যাদি সম্বন্ধে বলা হোক। জননগতস্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায় সে সব জানানো হোক।

নিজেকে না চিনলে নিজের অধিকার, সম্ভাবনা, পোটেনশিয়ালিটি সম্বন্ধে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রাতে পর্ণসাইটের খদ্দের আর দিনে নীতিনিপুণ সমাজরক্ষক ভণ্ডদের সংখ্যা যত কমে তত মঙ্গল। সত্যিটা যত স্পষ্ট, স্বচ্ছভাবে সামনে আসে সে-ই মঙ্গল। প্রত্যেককে নিজেকে ঠিক করে নেওয়ার স্বাধীনতা থাক সে কার সঙ্গে কতটা কম্প্যাটেবল। তাকে হাজারবার ভুল করার স্বাধীনতা দেওয়া থাক। তবে যদি একটা সংবেদনশীল, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সমাজ হয়। শুধু নীতিপাঠ দিয়ে, সংস্কারের গল্প শুনিয়ে কার্পেটের নীচে ধুলোই জমানো হয়। আর কিছু হয় না।