বাউল গাইল - “অরসিকে জানবে কেনে?”। “দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না”।
কথা কী উচ্চারণ করলেই মরমে বেঁধে? তুবড়ির মত ফেটে গিয়ে অর্থের আলোয় আলোকিত করে অন্তর?
না রে ভাই। অত সোজা নয় ব্যাপারটা।
বিবেকানন্দ বলছেন, তুমি একটা বিশালাকায় গোটা লাইব্রেরি মুখস্থ করে নিতে পারো। কিন্তু বুঝলে কী?
না। তুমি ততটাই বুঝবে যতটা বোঝার শক্তি তুমি অর্জন করেছ।
========
আমি কিছু একটা ভাবলাম। সেই ভাবনাকে শব্দের সংকেতে বাতাসে ধ্বনি তুলে তোমার সামনে বললাম। তোমার কানে গিয়ে শব্দগুলো সংকেতের পোশাক ছেড়ে অর্থের আকার ধারণ করল। কিন্তু তারপর? সে অর্থগুলো সঠিক সজ্জায় সেজে, বক্তার বক্তব্যের অনুরূপ আকার কি তোমার চিত্তে ধারণ করল? উঁহু। সে আকার ধারণ করবে তোমার চিত্তের গঠনের খাঁজ আর গঠনের অনুরূপ। তাই লোকে বলে না, ধান বললে কান শোনে। বলি এক, বোঝে এক। রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলছেন, কারেই বা বলি, কেইই বা বোঝে!
“কোথা তুমি মোর অজানা সাথি, কাটাও বিজনে বিরহ রাতি/ এসো এসো উধাও পথের যাত্রী/ তরী আমার টলোমলো, ভরা জোয়ারে”।
ওগো দরদী! এসো এসো। তুমি না এলে আমার কথা বুঝবে কে?
=======
ধরো তুমি বললে, পুজো তো এসে গেল।
এখন যাকে বললে, সে যদি “পুজো” মানে দুর্গাপুজো না বোঝে, সেকি আদৌ বুঝবে তুমি কী বললে? না বুঝবে না।
তাই তোমার কথা সে-ই বুঝবে যার জ্ঞানের ধারা তোমার জ্ঞানের ধারার সঙ্গে মেলে। যার রসের ধারা তোমার রসের ধারার সঙ্গে মেলে।
নইলে কী হবে?
সে আর ব্যাখ্যা করতে হবে গো? রাতদিন দেখছ না চাদ্দিকে। “দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বোঝাতে নারে আপনায়”।
এই হচ্ছে চাদ্দিকে। তুমি খোঁজো তোমার কথা কেউ বুঝুক। এ চার আনা বোঝে। ও আট আনা বোঝে। সে এক আনা বোঝে। তোমার ষোলো আনা কেউ বোঝে না। বুঝবেও না। কারণ ভাষার সে ক্ষমতা নেই। ভাষা শুধু অর্থহীন সংকেত। সে সংকেত ভেঙে বোধ অর্থ করে। সে বোধের সঙ্গে বোধের যদি মিল না হয়, তুমি গোটা মহাভারত লিখেও তাকে বোঝাতে পারবে কী গো?
=======
আমি যখন চুপ করে আমার ঘরে বসে থাকি। আমার জানলার বাইরে গোটা জগতের দিকে তাকাই। দেখি, গাছের পাতা, আকাশের রঙ। অনুভব করি বাতাসের স্পর্শ। আমার ভিতরের দিকে তাকাই যখন, সেখানে নানা ভাবনা, অনুভব। আমার বাইরে ভেতরে কত ভাষা। গাছের পাতায়, আমার সুখ-দুঃখে…কে যেন কী বলতে চাইছে এই বাইরে ভিতর সবটা মিলিয়ে। আমি কী বুঝতে পারছি?
প্রাচীনকালে উপনিষদের ঋষিরা বুঝেছিলেন ভাষার সীমাবদ্ধতা। বলেছিলেন, মন আর বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে। কিন্তু আনন্দ তাঁকে আনন্দের মধ্যে খুঁজে পায়। যে আনন্দের রূপ সংসারে শান্ত-শিব-অদ্বৈতের মধ্যে। আমি যদি শান্ত হই তবে আমার মধ্যে মঙ্গলের প্রতিচ্ছবি জাগবে। সেই প্রতিচ্ছবিতে দেখব গোটা সংসার “এক”-এর মধ্যে জাগ্রত চিরটাকাল। স্বামীজি গাইছেন, “অবাঙমানসগোচরম্”/ বোঝে - প্রাণ বোঝে যার।”
======
পাশ্চাত্য দর্শন যখন ভাষার গভীরে গিয়ে ভাষার সঙ্গে ভাষার সঙ্গতির দিশা খুঁজছে, সেখানেই প্রাচীন প্রাচ্যের দর্শন উপনিষদে, তাও-দর্শনে জগতের সঙ্গে বোধের সঙ্গতি খুঁজেছে। “বেসুর বাজে রে/ আর কোথা নয়, কেবল তোরই আপন-মাঝে রে”।
আমাদের দুই সত্যকেই দরকার। ভাষার সঙ্গতি আর বোধের সঙ্গতি দুই-ই।
পাশ্চাত্যের দুই বিজ্ঞানী, অসামান্য একটা বই লিখেছিলেন, Meaning and Relevance, লিখেছেন, Deirdre Wilson and Dan Sperber. এ বইটা পড়তে পড়তে মনে হল তাই তো প্রাণের গভীরে যে ভাষাকে জীবন্ত করে অর্থ উপহার দেয়, সে কে? “কে গো অন্তরতর সে”?
জানি না আমরা। শুধু জানি শুধু ভাষা নয়, ধ্বনি নয়, নীরবতারও এক সঙ্গতিপূর্ণ অর্থ সে জানে। তাই মাঝে মাঝে বাইরে যখন ঝড়, তখন সে আমার মধ্যে কী গভীর নীরবতা গড়ে তোলে। আমি সেই সাগরে পাড়ি দিই, একা। জানি সে আমায় কোথাও না কোথাও নিয়ে যাবেই।
======
তবু থেকে যাবে অসীম অব্যক্ত। যা বলা হয়নি। যা বলা হয় তো বা কোনোদিন সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই শেষ করি এ লেখা তাই….
হেথা যে গান গাইতে আসা আমার
হয় নি সে গান গাওয়া--
আজো কেবলি সুর সাধা, আমার
কেবল গাইতে চাওয়া।
আমার লাগে নাই সে সুর, আমার
বাঁধে নাই সে কথা,
শুধু প্রাণেরই মাঝখানে আছে
গানের ব্যাকুলতা।
আজো ফোটে নাই সে ফুল, শুধু
বহেছে এক হাওয়া।
আমি দেখি নাই তার মুখ, আমি
শুনি নাই তার বাণী,
কেবল শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার
পায়ের ধ্বনিখানি।
আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন
করে আসা-যাওয়া।
শুধু আসন পাতা হল আমার
সারাটি দিন ধ'র--
ঘরে হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে
ডাকব কেমন ক'রে।
আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে
হয় নি আমার পাওয়া
(ছবি Joydeep Ghosh)