সুখের সময় মনের খোঁজ কোথায়? যেমন দাঁতে ব্যথা না হলে দাঁত কোথায়? মন মানে তো দুঃখ। যখন বুকের মধ্যে টান। খামচা। তখন বুঝলে মন আছে। আবার তুমিও আছো। দুঃখকে বলো মন। নইলে মন বলে আবার কিছু হয় নাকি?
যখন খুশীতে আছি, তখন পুরোটা জুড়েই আমি। কোথাও কোনো ভাগ-বাটোয়ারা নেই। যেই দুঃখ এলো, অমনি নিজেকে আলাদা করা। যেন বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে ছাদের তলায় এসে দাঁড়ানো। আমি দুঃখ নই। আমার দুঃখ আছে, আমি দুঃখ নই। কিন্তু আমার সুখ আছে বোধ নেই। আমি আর সুখ একই। কিন্তু আমি আর দুঃখ আর এক হলাম না।
এখন কথা হল, দুঃখ কে চায়? গালিব বলছে হৃদয় ব্যথা হলে ওষুধের ব্যবস্থা করো, কিন্তু ব্যথাই যখন হৃদয়, তখন? তখন দুঃখকেই পান করো।
দুঃখকে পান করে আমি নিজেই যদি দুঃখ হয়ে উঠি? কোথাও আর নিজেকে দুঃখ থেকে যদি আড়াল না করি? মানে কি দুঃখ বিলাসিতা? শখের দুঃখ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে মনের মধ্যে যে বিকৃত সুখ, সে হতে পারে বিলাসিতা। কিন্তু সত্যকারের দুঃখকে স্বীকার করে নিয়ে মনের মধ্যে যে শান্তি, সে বিলাসিতা হয় কি করে?
নদীতে যখন ভীষণ ঝড় তখন নিজের নৌকাকে সেই ঝড় থেকে আলাদা ভাবা মূর্খামি, আবার সেই ঝড়ের মধ্যে গা ভাসানো আরো মূর্খামি। কিন্তু ঝড়ের মধ্যে নৌকাকে ভাসিয়ে রাখার যে চেষ্টা, ঝড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সে চেষ্টা। সে সামঞ্জস্য মানে শান্তি। উদ্বেগহীনতা।
গালিবের দুঃখে উদ্বেগ নেই। রবীন্দ্রনাথের দুঃখে উদ্বেগ নেই। শ্রীহীন হাহাকার নেই। আছে ঝড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরির সাধন।
আমরা যাকে পোড় খাওয়া মন বলি, এ সেই মনের গল্প। যে বাড়ির ছাদে দু বছর আগে নিজেদের সন্তানের শ্রাদ্ধের শামিয়ানা দেখলাম, সে বাবা মাকেই যখন রাস্তায় দেখি, কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি দেখি, বুঝি ঝড় থামেনি, ঝড়ের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। নৌকার দুলুনিতে উদ্বেগ নেই, সামঞ্জস্য এসেছে ঝড়ের সঙ্গে।
কঠিন? অবশ্যই কঠিন। নইলে গালিব গালিব হবেন কেন? আর যুগান্তরের পর সে এসে আজও ধাক্কাই বা দেবে কেন? সেকি শুধু ছাপাখানার দৌলতে? না, না, বোধের মধ্যে সে কঠিন সত্যের দিকে ঝোঁক আছে বলেই তা যুগান্তর পেরিয়ে আমার আঙিনায় এসেছে গালিব, রবীন্দ্রনাথ। দুঃখকে পান করে মানুষ দুঃখী হয় না, সত্য হয়। নইলে গীতবিতান আজ আশ্বাস হত না, আশ্রয় হত না, দুর্বলের প্রশ্রয় হত।