ভাগবত একটা কথা বলে বসলেন, দেখো, এই যে মাটি, এই যে মাটিকে শুকিয়ে তুমি নানা বাসন বানাও, কাউকে বলো থালা, কাউকে বলো ঘটি, কাউকে গ্লাস, আদতে তো সব মাটি, তাই তো? এখন যদি বলো মাটি সত্য না বাসনগুলো সত্য? আমি বলি কি, তুমি সব কিছুকে মাটি বলে খেলাটাকে মাটি করে দিও না, মাটি যে যে রূপ ধারণ করেছে, সেই সেই রূপে না হয় ডাকলে তাকে। সেই হোক বাস্তব।
কথাটা তবে কি দাঁড়ালো, বাস্তব মানে কি? বাস্তব মানে তবে দাঁড়ালো, যা আছে তার সঙ্গে আমার চিন্তা বা কল্পনা। ইংরাজিতে বললে, ফ্যাক্টের গায়ে আমার কল্পনার কোটিং। যেমন ধরো সিমেন্ট, ইট দিয়ে বানানো একটা ঘেরা স্থানকে আমি কখনও বলছি বাড়ি, আবার কখনও বলছি মন্দির। বাড়ি বা মন্দির - যাই হোক, সে বাস্তব। ফ্যাক্ট কি? না একটা নির্মাণ। তার সঙ্গে আমার চিন্তা যোগ হয়েই হল বাড়ি। আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি। আমার মন্দির, তোমার মসজিদ, আমার চার্চ, তোমার গুরুদোয়ারা।
এটাই খেলা। আমার কল্পনায় তুমি আমার প্রেমিকা, তুমি আমার ভাই, তুমি আমার বন্ধু। চিকিৎসকের কাছে তোমরা সবাই মানুষ। এক হাস্পাতালে এক এক মানুষের জন্য এক এক মানুষের চিন্তা। চিকিৎসকের কাছে সব সমান। শুধু শরীর। শুধু ফ্যাক্ট। তবে কি শুধু ফ্যাক্ট দিয়ে জীবন চলে? না তো। তাই আমাদের কল্পনা আমাদের চিন্তার জগতেই আমরা আমরা হয়ে দাঁড়াই। আমাদের সুখ, আমাদের দুঃখ সব ওইটুকুতেই তৈরি হচ্ছে, ওইটুকুতেই ভেঙে যাচ্ছে।
কথাটা কঠিন। ভীষণ কঠিন। মন যুক্তি সাজায়। কল্পনা করে। পার খোঁজে। এমন কিছু খোঁজে যা অমর, যা নিত্য, যা ধ্রুব। একে তাকে আঁকড়িয়ে বসে। সমস্ত কিছু তার হাত থেকে খসে খসে যাচ্ছে। কিছু তার মনের মত হচ্ছে না। তার অভিযোগ জন্মাচ্ছে। ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। কাউকে বলার পাচ্ছে না। একজন কাউকে তো সব বলতে হবে নাকি? বলার মত কাউকে বানিয়ে নিচ্ছে। তার জন্য ঘর বানিয়ে, তাকে নানা সাজে সাজিয়ে, তাকে নানা উপঢৌকনে সাজিয়ে বলছে, তুমি আমার কথা শুনে চলো, তুমি আমার ইষ্ট। আবার খেলা ভেঙে যাচ্ছে। আবার সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার সব ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে কি কিছুই ধ্রুব নয়?
এমন সময় জন্মালো বাঁশি। সে বলল, আমার প্রাণের কেন্দ্রে যে সুর, সে নিত্য। কিন্তু তাকে তো এমনি এমনি পাওয়া যায় না। এমনি পেতে গেলে আমি শুধু ছিদ্র, আমি শুধু বাঁশের এক টুকরো। কিন্তু যে সাধক সে জানে আমার প্রাণে জাগে সুর। সে সুর নিত্য। এ বিশ্বসংসার সৃষ্টিই হল সেই সুরে। সব রঙ, সব রূপ, সব রস সেই সুরের নানা প্রকার। সুরে জন্মাচ্ছে আবার সুরেই গিয়ে মিশছে। সেই সুর কি তুমি তুলতে পারো আমার প্রাণে? বাঁশি এই বলে মুখের দিকে তাকালো।
কিন্তু আমার যে অনেক কাজ বাঁশি! আমার সে সুর খোঁজার সময় কোথায় বলো? তার চাইতে এসো তোমায় একটা ঘর বানিয়ে দিই, তোমায় মালাচন্দন দিয়ে পুজো দিই, তোমার নামে স্তব বানাই। তোমায় আরতি করি, ধুপধুনো দিই।
বাঁশি বলল, সে তুমি দিতেই পারো। এ সব করতেই পারো। কিন্তু এতে তো আখেরে তুমিই পড়বে ফাঁকিতে। ঢক্কানিনাদ হবে। সুর উঠবে কি?
কিন্তু আমার যে সময় নেই বাঁশি! আমার স্বরে উষ্মা, আমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত, আমার মস্তিস্ক ধুমায়িত। মন স্থির হল কই যে বসে সুর সাধি?
বাঁশি বলল, তবে আমি আজ আসি। যেদিন সব মিটে যাবে সেদিন আমায় খুঁজো। আমি আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে আছি। এমনকি তোমাদের বানানো নর্দমার জলের স্রোতেও ওঠে সুর, তোমাদের ব্যস্ত কানে সে গিয়ে পৌঁছায় না।
এই কথা বলেই ভাগবতকারকে শুরু করতে বললেন ভাগবত রচনা। বললেন, দেখো সুরকে শুধু সুরের জন্যেই খোঁজো, আমোদের জন্য না। যেদিন নিজের প্রাণে সুরের অভাব জাগবে সেদিন বুঝবে সুরের নিজের মধ্যে নিজের কি মাহাত্ম্য! "শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি, বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি"। এই শূন্যতা না জাগলে সুরের সাধন শুরু হয় কি গো?
তবে আমার সংসার, আমার নিজের বেড়া দেওয়া এই ছোট্টোখানি আয়োজন, সব হারিয়ে যাবে যে?
বাঁশি বলল, তাই কি হারায়? তোমার আঙিনায় যখন চাঁদের আলো এসে পড়ে, সূর্যের আলোয় তোমার বাগান হয়ে ওঠে পুষ্ট, তুমি কি সব হারানোর ভয় করো? সে তো লক্ষ যোজন দূর থেকে কত গ্রহ-তারকা ছাপিয়ে এসে দাঁড়ায় তোমার আঙিনায়। তবে? এই যে সেদিন, মেয়েটা যখন বলল, একমাসের জ্বরে সে কাবু হয়ে একা একা দিনরাত কাটালো। কখনও বারান্দায় বসে, কখনও শুয়ে, ক্লান্তিতে, দুশ্চিন্তায়…. তোমার বুকে বাজল না কথাটা? সে তোমার কে হয়? আপাতদৃষ্টিতে কেউ না। কিন্তু আপাতদৃষ্টি আপাত বলেই এত অগভীর। গভীরের কথাটা হল বুকে বাজে গভীর সুর। গভীর প্রাণে গভীর কান্না ওঠে, গভীর তাগিদ ওঠে ডানা মেলার, তা দাবিয়ে রাখ আপাত কিছুর অজুহাতে। তাই এত ভয়, এত আড়াল। নয় কি? একদিন সব আপাত ভেঙে পড়বে, সেইদিন আমায় ডেকো, আমি আসব, আমার প্রাণে সুরের দ্যোতনা খুঁজো। আমি সাড়া দেব। মিথ্যা বাইরে আর এটা সেটা বানিয়ে আমার খণ্ডিত করে নিজেকে ব্যর্থ কোরো না।