Skip to main content
 
(আজ গুরুপূর্ণিমা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোতে আনার প্রয়াসে বহু প্রাণ আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে আলোর পথ খুঁজেছেন। বাইরের বিশ্বে তা বিজ্ঞান, মননের গভীরে তাই অধ্যাত্মজ্ঞান। দুটো পথেরই প্রধান অন্তরায় – লোভ। কোথাও ধনের তো কোথাও মানের। 
 
আজ যখন নীচের এই লেখাটি পোস্ট করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন এক অনুজের কাছ থেকে একটা মেসেজ পেলাম। সে লিখছে, ‘তিনি কাউকে নকুলদানা দেবেন, কাউকে সন্দেশ। যা দেবেন নিজের হাতেই দেবেন। আমার নকুলদানাই সই, অন্যের সন্দেশে লোভ করে তাঁর হাতের স্পর্শ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে রাজী নই।‘ 
মনটা দ্রবীভূত হল। যে সংকট থেকে নিজেকে সে উদ্ধার করার পথ নিজের মধ্যেই সে পেল, সেই সে আলোটুকুই সংসারে সার। সে আলোক শিখার ধারক ও বাহক সকল আত্মাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই আজকের এই পবিত্র তিথিতে।)
 
 
'যতো বাচা নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহা'
 
‘যেখান থেকে মন ও বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে’
 
 
 
এই একটি পঙক্তিতে সমগ্র অন্তর্জগৎ আর বহির্জগতের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট দাগ টানা হল। আমার চিন্তা বাক্য নির্ভর। শব্দ নির্ভর। রূপ ও শব্দ ব্যতীত চিন্তা অসম্ভব। এ নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে বহু সুন্দর সুন্দর গভীর আলোচনা হয়েছে। রাসেল ও উইটেঞ্জেস্টাইন এর নাম অগ্রগণ্য। 
আলোচনা সেটুকু নিয়ে না। যা বলতে চাই তা হল, এই শ্লোকটাতেই আমার বাগানে বেরোবার পথের ইঙ্গিত আছে। অসীম সাগরে ভেলা ভাসাবার জন্য নোঙর তোলার শক্তি দেয় এই খণ্ড শ্লোকটি। সে পিঠে হাত রেখে বলে, ভাই রে, যাকে তুমি চাইছ, সে তোমার এ পোশাকে আসবে না। আমি বলি তবে? সে বলে, তোমায় তোমার মনের পোশাক, চিন্তার পোশাক খুলতে হবে। নগ্ন হতে হবে।
পুরো সংসারটা যখন পার্থিব সুখ-দুঃখ, চাওয়া- পাওয়ার হিসাব নিকাশে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে, আমার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে বলছে, "ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়, তবু জেনো মন তোমারে চায়", তখন এই শ্লোকে আমি আশ্রয় পাই। নিভৃতে একান্তে, বাইরের সংসারকে বাইরে রেখে প্রবেশ করি অন্তর্লোকে। একা, আমার চির অপেক্ষমাণ প্রিয়তমের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তুমি যদি নিজের মধ্যে শান্তি খুঁজে না পাও, তবে পৃথিবীর কোনো গুহা, কোনো মন্দির, কোনো সাগরতীরে শান্তি খুঁজে পাবে না। 
একদম ঠিক কথা। সেখানে বিশ্রাম মিলতে পারে, শান্তি না। আমার মাথার মধ্যে অহোরাত্র যে শব্দের স্রোত বয়ে চলেছে, যে চিন্তার ঘূর্ণিপাক তৈরি হয়ে চলেছে, তাকে যদি সময় মত থামাতে না পারি, তবে সে আবর্তের পর আবর্ত তৈরি করে আমায় গ্রাস করবে। সে চিন্তাস্রোতের প্রয়োজন আছে, তবে সে প্রয়োজনের বেড়া ডিঙিয়ে অপ্রয়োজনের রাজ্যে ঢুকলে আমার অন্তঃকরণকে ক্ষত বিক্ষত করে তোলে। তাকে থামাতেই হবে। 
একটা প্রশ্ন এখানে উঁকি দিয়ে যায়। যদি মন ও বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে, তবে আমি পাব কি করে? এর উত্তর সোজা কথায় দেওয়া শক্ত। কারণ, ‘কথা চিন্তা বাক্য’ - সব এক গোত্রীয়। শব্দমালা। তার তো সে পথে যাওয়ার অধিকার নেই। তবে? তবে এর উত্তর একটু অন্যরকম। কার চিন্তা, কার মন তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে? খুঁজতে হবে। এত চিন্তা, এত অনুভূতি - এসব কার? আমি যে রাত দিন, "আমার মনে হয়...আমার ভাললাগা মন্দলাগা, আমার অধিকার অনধিকার, আমার দুশ্চিন্তা হতাশা" ইত্যাদির ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর আসল ভোক্তা কে? আমি কি মন? আমি কি চিন্তার জাল? আমি কি বুদ্ধি? আমি কি প্রাণশক্তি? আমি কি আবেগের জটাজাল? আমি কি?
আমার ঘুমের মধ্যে যে গভীর চেতনা জাগ্রত থাকে, যে স্বপ্নগুলোকে দেখে, যে আমার জেগে থাকাকে দেখে, যে আমার গভীর ঘুমন্ত দশা দেখে - সে কে? আমার গভীরতম ঘুমের থেকে যখন আমি উঠি, কে আমায় সাজিয়ে গুছিয়ে বাইরের সংসারে পাঠায়। কিছুই তো হারায় না। সেই গভীর ঘুমের মধ্যে তো আমার শোক, দুশ্চিন্তা, হতাশা কিছুই কাজ করে না। অথচ আমি তো মৃতও নই সে সময়টাতে। আমি ঘুমন্ত। তবু কোন সে গভীর চেতনায় জাগ্রত? যেখানে আমার তৈরি করা সংসারের তিলমাত্র আঁচও প্রবেশাধিকার পায় না? 
সেই সময়টাতে যে জেগে থাকে, তাকে যদি বাইরের জেগে থাকার সময়েও অনুভবে আনতে পারি, তবে আমার অন্দরমহলে আর বাইরের সংসারের বিষ ঢোকে না। আমি অনাসক্ত থাকতে পারি। একটা সিঁড়ি ছাড়তে হলে, আরেকটা সিঁড়িতে পা দেওয়া চাই আগে। এই শ্লোকটি সেই সিঁড়ির ধাপ। সেই গানের কথা মাথায় আসল -
 
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
 
অরূপ রতন আশা করি;
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর
ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
 
সময় যেন হয় রে এবার
 
ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে
অমর হয়ে রব মরি।
 
যে গান কানে যায় না শোনা
 
সে গান সেথায় নিত্য বাজে,
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে।
 
চিরদিনের সুরটি বেঁধে
 
শেষ গানে তার কান্না কেঁদে,
নীরব যিনি তাঁহার পায়ে
নীরব বীণা দিব ধরি।