Skip to main content
 
 
একবার মা’কে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি ডাক্তার দেখাতে। এমন রোগ যার চিকিৎসাশাস্ত্রে নিরাময়ের পথ নেই, চরম পরিণতিকে ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। তবু সেইটুকুই আশার আলো।
       গাড়ি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটছে। আমার একটা কথাই মনে হয়েছিল সেদিন, যে কথাটা আজও কোথাও খুঁটিটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখে আমার, সে কথাটি হল – দুঃখ আছে।
       দুঃখ আছে – এ তো শুধু একটা কথা না, মন্ত্র। সংসারে দিবারাত্র আমার একটাই প্রচেষ্টা আমার চলনে-বলনে-আশায়-আকাঙ্ক্ষায় – 'দুঃখ নেই' -- এই কথাটাকে সত্য করার। নিজেকে মিথ্যা বলে, নানা ছলনায় নিজেকে ভুলিয়ে এই কথাটাই রাতদিন যেন নিজেকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চাই – জগতে দুঃখ থাকলেও আমার জীবনে দুঃখ নেই, থাকতে পারে না, যদি থাকে সে আমার ব্যর্থতা।
       কিন্তু সে সব অলীক সুখের জাল ছিঁড়ে যে কথাটা চরম মুহূর্তে সত্য হয়ে ওঠে – তা এই কথাটাই – দুঃখ আছে।
       কথাটা বুদ্ধের। কিন্তু কথাটার সুরকে চিনেছি রবীন্দ্রনাথে। প্রাণের সাথে মিশেছে তাঁর উচ্চারণে। নানা গান, নানা প্রবন্ধ, নানা কথোপকথনে দেখেছি দুঃখকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই – এই কথাটাই বারবার করে বলছেন। অগৌরব সে দুঃখকে এড়িয়ে গেলে। ক্রমে দুর্বল হয়ে গিয়ে, সেই দুর্বল সত্তার তত্ত্বাবধানে নিজেকে নিয়ে রাতদিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকার নির্লজ্জ আত্মকেন্দ্রিকতায়। এ সুখ নয়, এ হীন তামসিকতা।
       বুদ্ধের ঈশ্বর ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ ছিল। রবীন্দ্রনাথের ছিল আনন্দ। দীপের শিখা নির্বাপিত হওয়া যদি নির্বাণ হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের ছিল সেই শিখায় আত্মদানের হোমাগ্নিতে নিজেকে নিঃশেষিত করার আনন্দ।
       রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলছেন। রবীন্দ্রনাথ বসার ঘরে বুদ্ধের মূর্তি রাখছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধমূর্তির সামনে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের দর্শনে উপনিষদের বাণীর সুর খুঁজে পাচ্ছেন, সেই বাণীতে লাগছে বৈষ্ণব পদাবলীর রস। এ কি করে হয়? যিনি শূন্যবাদী, সেই বুদ্ধের সুরে কি করে 'পূর্ণমিদং'-এর মাধুর্য লাগে?
       ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথের কাছে বসলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় সে সুর কিভাবে লাগে। তার ব্যাখ্যা নেই। ‘সাধনা’ বলে যে একটি ইংরেজি পুস্তিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজের অধ্যাত্মবোধের একটি ধারণা গড়ে দিতে গেছেন, তাতে যেন অনেক কিছু বলা হল না। কিন্তু সমস্ত গীতবিতান, সমস্ত ছিন্নপত্র, সমস্ত রবীন্দ্রনাথ জুড়ে যে সুরটা – যে সুরে বাদী-সমবাদী সুর হয়ে থাকল – সত্য ও মঙ্গলচেতনা। যা অনুভবে সুখ না, আনন্দ। সত্য ও মঙ্গলের বোধ যে আনন্দ অনুভবে তার কি কোনো নির্দিষ্ট দেশকাল বাঁধা দর্শন হতে পারে? সত্য ও মঙ্গল যখন আলোচনার বস্তু তখন তাতে তর্কের আর আত্মবিজ্ঞাপনের শেষ নেই। কিন্তু সেই সত্য ও মঙ্গলবোধ যখন অনুভবের সেখানে আমার কোনো তর্ক নেই। শূন্যতা ও পূর্ণতার দ্বন্দ্বই বা কোথায়?
       আমার বন্ধুকে আমি যে জানি সে আমার অনুভবে, যেভাবে জানি তাকে বাইরে থেকে সেভাবে জানা সম্ভব নয়। শিশুকে মা যেভাবে জানে তেমন পাড়ার লোকে জানে না, এই কারণেই। তাই আমার বন্ধু অথবা সেই শিশুটিই হোক না কেন, তার কিসে মঙ্গল তার জন্য আমায় লাইব্রেরীতে গলদঘর্ম হয়ে উপদেশের ফর্দ বানাতে হয় না, তা আমি এমনিতেই বুঝি, সে আমার অনুভব। সে আমার আনন্দ। তার জন্যে হাজার দুঃখ সহ্য করেও সে আনন্দ।
       কিন্তু এভাবে সত্যকে আর মঙ্গলকে জানতে যে অনুভব – সে কি ভালোবাসা নয়? এমন ভালোবাসা আমি পাই কই? ভালোবাসা কি অভ্যাসের দ্বারা প্রাপ্ত ধন?
       শব্দটা এখানে একটু খটমট। আসলে কথাটা ভালোবাসা নয়, কথাটা সিমপ্যাথি বা সহমর্মিতা। যে শব্দের উপরে দাঁড়িয়ে সমস্ত নীতিমালা। আমি যদি সেই সবল অনুকম্পায় নিজেকে স্থির, দৃঢ়চিত্ত না করি, তবে অন্যের জন্য কেঁদে ভাসাতেও আমার যেমন সময় লাগে না, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাকে আঘাত করে বসতেও তেমন দেরি হয় না। সহমর্মিতা কোনো আবেগপ্রবণতা নয়, এ এক সহজাত প্রবৃত্তি। অ্যাডম স্মিথ তার কালজয়ী বই, 'দ্য থিওরি অব মর‍্যাল সেন্টিমেন্ট' -এ বলছেন, অতিবড় পাষণ্ডও অতি ক্ষীণতম সহমর্মিতাবোধহীন হওয়া সম্ভব নয়।
       আমার গান গাইবার ক্ষমতা হয় তো প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর মত নয়, কিন্তু তবু আমি গান গাই না? গাই তো। তেমনি আমার সহানুভূতির বোধ নাই বা হল কোনো মহানুভবের তুল্য, তবু তা আমার জীবনের জন্য অর্থহীন নয়। আমার তরী আমার এই একমুঠো সহানুভূতিতেই তীরে এসে ঠেকবে। নাই বা হল আমার অনুকম্পাবোধের উদযাপন, আমার নিজের চিত্তে একান্তে একটা জানলা খোলে সে - ই বিরাট বিশ্বের দিকে। আমার এই চোখেই আমি কাঞ্চনজঙ্ঘার রাজকীয় শোভায় মুগ্ধ হই, আমার এইটুকু হৃদয়ের অনুভবকে সম্বল করেই। আমার বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসি এই আমার একরত্তি প্রাণের আকুতিকেই সম্বল করে। তবে আমার সহানুভূতির বোধই বা দুর্বল, অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে থাকবে কেন? ওইটুকুতেই আমার মুক্তি, আমার ক্ষুদ্র আমি-র থেকে বৃহৎ আমি-তে উত্তরণের সোপান। তাকে হারাতে চাই না বলেই আজকের বুদ্ধ পূর্ণিমায়, আগামীকালের পঁচিশে বৈশাখে ক্ষুদ্র ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়াই, বলি, তোমার অনেক আছে, তার থেকে আমায় একমুঠো দিলেই যায় চলে।