"Fibonacci সিরিজ শিখলাম" - আমার একজন কনিষ্ঠ বন্ধু কম্পিউটার ক্লাস করে আসার পর বলল। কি বস্তু সেটা? ১,১,২,৩,৫,৮... অর্থাৎ সিরিজ শুরু হয় প্রথম দুটি সংখ্যার যোগফল দিয়ে। তার প্রথম সংখ্যা ০ হতে পারে, ১ হতে পারে। সিরিজের এর পরের সংখ্যাগুলোর প্রতিটি তার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। এইরকমভাবে সিরিজ চলতে থাকে। মনে পড়ল আমাদের বোটানি ক্লাসে এই সিরিজের উল্লেখ পেয়েছিলাম পত্রবিন্যাস বুঝতে। অর্থাৎ প্রতিটা গাছের পাতার নির্দিষ্ট বিন্যাস পদ্ধতি।
তবে কি অঙ্ক বোঝানোর জন্য খামোখা কলম কামড়ে পড়লুম? তা নয়। হল কি, এই সিরিজের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে যেটা চোখে পড়ল তাতেই সমস্ত মনপ্রাণ আটকে গেল। এই সিরিজের প্রথম প্রামাণ্য লিখিত প্রমাণ নাকি মেলে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে, ছন্দ উপাখ্যানে। যে প্রয়োজনেই এসে থাকুক, ভারতে এ চিন্তা করা হয়েছিল তবে। আরো খুঁজতে গিয়ে জানলাম, কেরালার প্রাচীন গণিতের উপর উইকিতে ইতিমধ্যে একখানা পেজও বর্তমান।
খটকাটা লাগল অন্য জায়গায়। এত অবৈজ্ঞানিক ভাবধারায় বয়ে চললাম কেন আমরা তবে? যদি আমাদের পূর্বপুরুষদের এ হেন মেধার বিন্যাস বিজ্ঞান গবেষণায় ছিল, তবে সে এগোলো না কেন?
এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক, আমাদের প্রাচীনেরা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকে যে আগ্রহ অনুভব করেছিলেন তা প্রয়োগের দিকে অনুভব করেননি হয়ত।
দুই, পরলোক, আত্মতত্ত্ব ইত্যাদিতে এত গভীর চর্চা শুরু হল যে এইসব জাগতিক, পার্থিবজ্ঞান তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে বোধ হতে লাগল।
আমার ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয়টাই বেশি কারণ মনে হয়। আমরা প্রধানত বিশ্বাসপ্রবণ জাত। আমাদের জীবনের মূলকেন্দ্রে গুরু বা ঈশ্বর বা কোনো অতীন্দ্রিয় দর্শন না থাকলে আমরা নিজেদের জীবনটা অর্থহীন মনে করি। আসল না পাই নকল দিয়েও কাজ সারতে রাজী আমরা। তবু কেন্দ্রে চাই-ই কাউকে।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। শিয়ালদাতে ট্রেনে বসে আছি। ২.০৫ ট্রেনের ছাড়ার সময়। বোর্ডে বড়বড় করে লাল অক্ষরে লেখা। তবু আশেপাশের কোনো ট্রেন হর্ণ দিলেই এই প্ল্যাটফর্মের লোক ছুটতে শুরু করছে। তারা প্রত্যেকেই কম বেশি জানেন ট্রেনটার ছাড়ার সময়, কিন্তু তবু যদি ছেড়ে যায়!
এইটাই ভয়ংকর মানসিকতার লক্ষণ। নিয়মের ঊর্দ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। যাকে স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়। জগতে সব চাইতে স্বেচ্ছাচারী তোষামোদখেকো অস্তিত্ব তাই আমাদের দেব-দেবীরা। জগতে একটা নিয়ম আছে, সব কিছুই একটা কার্য-কারণ সূত্রে গাঁথা, এটা আমরা কিছুতেই মানতে পারি না। এত নিয়মের তথ্যে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। ভক্তি খুঁজি। এমন কাউকে ভক্তির পাত্র খুঁজি যিনি আমার হয়ে সব ভেবে দেবেন, কিম্বা যিনি তাঁর ইচ্ছার দাস করে আমার স্বাধীনতাহরণ করবেন। আমি নিজের স্বাধীনতার দায় নিজে আর বইতে পারছি না যে!
সংসারে যারা প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটা কাজে, পদক্ষেপে ঈশ্বরের মঙ্গলহস্ত দেখে, ঈশ্বরের অভিশাপের নিদর্শন দেখতেও তাদের চক্ষুর অভাব ঘটে না। ক্রমে একজটাদেবী, হাজার একটা আইনকানুন, শাসনে অনুশাসনে জীবন একটার পর একটা শৃঙ্খলায় শৃঙ্খলিত হতে থাকে, আর আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকি যখন লোকটা নড়েচড়ে না, আমরা বুঝি 'শিক্ষা সম্পূর্ণ হইয়াছে'।
নিয়মকে না মানলেই অপমান। নিজের অপমান, নিজের চারপাশের অপমান। কর্তায় ইচ্ছায় কর্মের দিন চলে গেছে এখন। এখন সবে মিলি করি কাজ।
কিন্তু এই কাজটা ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ পারস্পরিক যোগাযোগের পথটা নির্মোহ, সংস্কারমুক্ত হয়। আমাদের সংসারে নিয়মনীতির অভাব নেই। অভাব মনুষ্যত্ব আর বিবেকযুক্ত নিয়মনীতির। কোনবারে কি খায় না, কিম্বা কোন ধরণের পাত্রের সাথে কোন ধরণের পাত্রীর বিবাহে কি কি অশুভ ও অমঙ্গলের সম্ভাবনা, তাই নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। একবারও মনে প্রশ্ন হয় না, তবে পৃথিবীর এত দেশে, এত সামাজিক বৈচিত্র্যে আর সব জাতিগুলো উচ্ছন্নে গেল না কেন? আমাদের নীতি-দর্শন-আস্থা সার্বজনীন কিনা ভাবার অবকাশ নেই আমাদের, অথচ সেই সব আজগুবি আচার অনুশীলনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অভাব হয় না আমাদের।
'পথের পাঁচালি'-র দূর্গার মৃত্যুর সে ভয়ানক রাতটার কথা ভাবুন। তাদের ঘরে কি ছিল না, দেব-দেবী, ধর্মগ্রন্থ, আচার-বিচার সব ছিল। ছিল না কেবল প্যারাসিটামল। ওষুধটা আবিষ্কার হল ১৮৭৭. মার্কিনমুলুকে এল ১৯৫০. বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে করতে ৬০/৭০ দশক। এই জ্বর নামানোর পদ্ধতি সার্বজনীন। আমেরিকানদের নামে আর চীনাদের নামে না বাতুলেও বলে না। বিজ্ঞানের সবচাইতে বড় কথা তার এই সার্বজনীনতা। তাকে এর ওর খিদমৎ খেটে মরতে হয় না। সে নিজেই নিজেতে সম্পূর্ণ সার্বজনীনতার জোরে।
পাশ্চাত্য দর্শনও সেই খোঁজটা করেছিল। তাই তাদের দর্শনের একটা সারিবদ্ধ ইতিহাস লেখা যায়। তার সমালোচনা করা যায়। ফলঃস্বরূপ তাকে এগিয়েও নিয়ে যাওয়া যায়।
আমাদের দর্শন নোঙর গাড়ল অতীন্দ্রিয়বাদে। আর অতীন্দ্রিয়বাদের কোনো সার্বজনীনতা সম্ভব নয়। তার অমোঘ আকর্ষণ আছে। কিন্তু সহজ সার্বজনীনতা নেই। এক চার্বাক ছাড়া প্রত্যেকেই আত্মা পরমাত্মার চক্করে পড়ে (চার্বাক ব্যক্তিগতভাবে আমার অসম্পূর্ণ, প্রতিক্রিয়ামূলক দর্শন বোধ হয়) গিয়েছিল।
আধুনিক যুগের প্রাক্কালে যে নিও বেদান্তইজ্মের ঢেউ এলো, ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে সেটা খ্রীষ্টের সেবাদর্শের একটা বৈদান্তিক মোড়ক। বিবেকানন্দ, মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শুধু না, প্রবলভাবে পাশ্চাত্যের ভাব ধারায় প্রভাবিত। তাই সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিও বেদান্তইজ্ম ছাড়া বিশেষ কোনো উপায়ও ছিল না। "জীবে প্রেম করে যেই জন" ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকপক্ষও উঠে দাঁড়ালো প্রার্থনা সমাজ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টিকে অবলম্বন করে। চলল সে ঢেউ, ভারতের দর্শনে বহু মানুষ প্রভাবিত হলেন সেদিন। একঘেয়ে খ্রীষ্টধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ আর বেদান্তদর্শনের মধ্যে একটা নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া গেল। রোমা রোল্যাঁ, টলস্টয়, ম্যাক্সমুলার, শোপেনহাওয়ার ইত্যাদি বহু মনীষী মুগ্ধ হলেন। আলোচনার স্রোত বইল। ভারত যেন সার্বজনীন হতে হতেও কোথায় ঠেক খেল। ঠেক খেল তার অতীন্দ্রিয়বাদে। এগিয়ে গেল বুদ্ধইজ্ম। আজ সারা বিশ্বে বুদ্ধচর্চার প্রবণতা দিন দিন ক্রমবর্ধমান, কারণ বুদ্ধ মানুষকে কোনো বিশেষ আত্মতত্ত্বে মুক্তির কথা শোনাননি, শুনিয়েছেন সার্বজনীন নীতির শক্তিতে - অষ্টাঙ্গিক মার্গে। জগৎকে প্রভুর লীলাক্ষেত্র বললেন না, বললেন, দুঃখ আছে - এই মোদ্দা কথা - আর্যসত্য।
কিন্তু সে অন্য গল্প। কথা হচ্ছে এই সার্বজনীনতাটুকুর। যা শুরুতেই বলছিলাম fibonacci সিরিজের গল্পে। এই সর্বগ্রাহক পটভূমিকায় যদি দাঁড়াতে না পারি, holier than thou করে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনো খামখেয়ালি ঈশ্বরের তোষামোদিতে জীবনের পরম সার্থকতা খুঁজি, তবে সবশেষে সেই old wine in new bottle হতে বাধ্য।
সৌরভ ভট্টাচার্য
26 August 2017