Skip to main content
shanti

সন্তান ঘরে না থাকলে সে ঘরে মা নেই। সে ঘরে তখন কেবল একজন মহিলা আছেন। রসিক ঘরে না থাকলে একটা ধাতব তার বাঁধা যন্ত্র আর ধাতব ধ্বনি আছে, সেতার নেই, মালকোষ কি মল্লার নেই। তেমন ভক্ত না থাকলে ভগবানের কোনো অস্তিত্ব নেই। ভক্ত ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা। ভক্ত, যে জানতে চায় না। ভালোবাসতে চায়। তার আদর্শ কে? হয় তো রুমি, কিম্বা চৈতন্যদেব, কি নানক, কি রামপ্রসাদ, কি রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত বা লালন কি কবীর।

কিন্তু তাঁকে কী জানা যায়? এই জানার ঘরানাটা দর্শনের। ভক্তের না।

পাশ্চাত্য দর্শন মানুষের জ্ঞানের সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতা, ভাষার সীমাবদ্ধতার কথা বারবার বলেছে।

পাশ্চাত্য দর্শনের এক মহীরুহ ইম্যানুয়েল কান্ট তার মহাগ্রন্থ ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ এ দেখাচ্ছেন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে। আধুনিক অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন দেখাচ্ছেন ভাষার সীমাবদ্ধতা। প্রভাবিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথে। তাঁর ‘'রাজা’ নাটকে।

কান্ট বলছেন আমরা যা কিছু বুঝি সে হল কনসেপ্টকে কেন্দ্র করে। কনসেপ্ট আমাদের মনের গঠন। সেই গঠনকে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে কান্ট আমাদের জ্ঞানের সৃষ্টির পথ দেখাচ্ছেন। সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছেন। আধুনিককালের জীবিত সক্রেটিস, নোম চমস্কির দর্শনেও এ তত্ত্ব স্বীকৃত। আমরা তা-ই জানতে পারি যা জানার ছাঁচ আমার মনে আছে। ধারণা বা কনসেপ্ট একটা ছাঁচ। কিন্তু দেশ-কালের অতীত, সময়ের অতীত কোনো সত্ত্বাকে জানার ছাঁচ কি আমার মনে আছে? নেই। তাই ঈশ্বর আমাদের বোধের গম্য নন। কারণ তত্ত্বগতভাবে তিনি এ সবের অতীত।

এ কথাই জানিয়েছেন উপনিষদ। “যাঁকে বাক্য ও মন না পেয়ে ফিরে আসে।” বাক্যমনাতীত তিনি।

মানুষের যে কগনিটিভ ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার সামনে ঈশ্বর নেই। শূন্য। কারণ ঈশ্বরকে ধারণা করার ক্ষমতা তার নেই। ভিটগেন্সটাইন দেখাচ্ছেন ভাষারও কোনো ক্ষমতা নেই জটিল ভাবকে বোঝাতে যথাযথ ভাবে।

ঈশ্বর নেই। এ সত্য। আছেন। এও সত্য। যেমন সন্তান না থাকলে মা নেই। মহিলা আছেন একজন। তেমন। ভক্ত থাকলে ঈশ্বর আছেন। নইলে নেই। চিত্রকর থাকলে ছবি আছে, নইলে সবটাই স্থূল রঙ আর আকার।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ধারণা” শব্দটার কথা। বলছেন, শুধু জানলে হবে না। ধারণা চাই।

কিন্তু তাঁকে ধারণা করা যায় না, এই কথাই তো হল এতক্ষণ। তবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, যায় যায়। তিনি শুদ্ধ বুদ্ধি, মনের গম্য। শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ মন আর শুদ্ধ আত্মা একই কথা।

এখন এই ‘শুদ্ধ’ কথাটার মানে কী?

দর্শন আর অধ্যাত্মকিতার পার্থক্য এখানেই। দর্শন সময়ের স্রোতে ভেসে এক যুগ থেকে আরেক যুগে আসতে পারে। দর্শন মূলত কনসেপ্টকে নিয়ে কাজ। সে কনসেপ্ট জ্ঞান সংক্রান্ত, নীতি সংক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু অধ্যাত্মিকতা কনসেপ্ট নিয়ে নয়। অনুভব নিয়ে। দর্শন চায় সত্য। অধ্যাত্মিকতা চায় শান্তি। পরমের সঙ্গে সাযুজ্য। আনন্দ।

উপনিষদের যে শ্লোকে বলা হল তিনি বাক্যমনাতীত, সেই শ্লোকের বাকি অংশে বলা হচ্ছে তিনি আনন্দের দ্বারা নিজেকে জানান। সেই আনন্দে তাঁকে জেনে মানুষ ভয় মুক্ত হয়।

এর যুক্তি কী? এর যুক্তি নেই। এ কাব্যময়তা। দর্শন, বিজ্ঞান আলোচনা মেধাসম্পন্ন যে কোনো মানুষের সঙ্গে হতে পারে। কিন্তু রসের আলোচনা রসিকের সঙ্গে ছাড়া হয় না। মল্লারে কেন চোখে জল আসে, পুরবীতে কেন মন উদাস হয়, এ যার হয় তার হয়। এ যুক্তির উপর নির্ভর করে না। এ এক রসগ্রাহীতার উপর নির্ভর করে। উপনিষদ বলছেন, তিনি রসস্বরূপ। আনন্দস্বরূপ। এ আনন্দ মানে সুখ না। এ আনন্দ মানে নিজেকে ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্বের আরেক পরম অস্তিত্বে ডুবে যাওয়ার তন্ময়তা। হয় তো দুঃখেই। “সুখের খেলায় বেলা গেছে পাইনি তো আনন্দ”।

ঈশ্বর যদি কাব্যময়তা হবেন, আনন্দস্বরূপ হবেন, ব্যক্তিগত উপলব্ধি হবেন, তবে এই চারদিকে এত ধর্ম কী?

ও হল সমাজবিদ্যার অংশ। ও হল নৃতত্ত্ববিদ্যার আলোচনার বস্তু। ও হল সামাজিক অর্থনৈতিক চর্চার জিনিস। সেও বাস্তব। কিন্তু অধ্যাত্মিক হিসাবে বাস্তব নয়। সমাজের উন্নতির কাজে যেমন নানা আন্দোলন, সেবা ইত্যাদিতে কাজে এসেছে। তেমন হিংসা, মৌলবাদের জন্মও দিয়েছে। দুই-ই সত্য।

তবে কথাটা দাঁড়ালো তিনি জ্ঞানের গম্য নন। কিন্তু আনন্দে প্রকাশিত। তাঁকে ধারণা করা মানে, শুদ্ধমন-বুদ্ধির গম্য মানে কী তবে? মানে তিনি আনন্দের ধন। শুদ্ধতা মানে আনন্দের আরেক নাম। সুখ বেশি হলে বিষ। সে খাওয়াদাওয়াই হোক, কী হৈ-হুল্লোড়ই হোক। কিন্তু আনন্দ? সে আরো গভীরে, আরো গভীরে নিয়ে যায়।

পাশ্চাত্য দর্শন আনন্দকে একটা অস্তিত্বময় স্বাধীন সত্ত্বা বলে মানে না। তারা ভাবে আনন্দ নানা মানসিক উপাচারের লব্ধফল। কিন্তু প্রাচ্য দর্শন আনন্দকে এক স্বাধীন অস্তিত্ব হিসাবে জানে। সচ্চিদানন্দ তত্ত্বে। এ তত্ত্ব চিন্তালব্ধ না। কারণ চিন্তা ভাষার শরীরে শরীরী। আনন্দ ভাষার অপেক্ষা রাখে না। নীরবতার অপেক্ষা রাখে। তন্ময়তার অপেক্ষা রাখে। নির্জনতার অপেক্ষা রাখে। নিজের ক্ষুদ্র একার মধ্যে পরম একের ডাক কান পেতে শোনে। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে যে ডাকে। যে কোনো চিন্তা নয়। সিদ্ধান্ত নয়। যে আনন্দ। আলোয় আলোকময় করে আসা আনন্দ। যে আনন্দের উপর নির্ভরশীল আমার জীবন। শ্বাস চললে যেমন শরীরের বাকি সব কাজ চলতে পারে। তেমনই আনন্দের আশ্রয়েই প্রাণ-মন-বুদ্ধির সব কাজ চলতে পারে। বিপরীতে জন্ম হয় বিকারের।

কল্পনা করুন দক্ষিণেশ্বরের ছোটো ঘরটায় বসে আছেন। সামনে চৌকিতে বসে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কেউ কোনোদিকে নেই। কোথাও নেই। তিনি আপনার দিকে তাকিয়ে। আপনি তাঁর দিকে তাকিয়ে।

এই ঘরে কত আলোচনা, কত গান, কত নাচ হয়েছে। এই ঘর থেকে কোনো বিদ্বেষ, কোনো প্ররোচনামূলক একটা কথাও উচ্চারিত হয়নি। হলে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে তর্ক হয়েছে, চোখের জলে ভালোবাসার আনন্দহাট বসেছে। এখান থেকে এমনকি এও বলা হয়নি যে আমার ধর্ম, আমার বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ। বলা হয়নি মা আমাকে বলেছেন মাকে যে না মানবে তাকে আঘাত করো। মায়ের ধর্ম শ্রেষ্ঠ প্রচার করো। বলা হয়নি। বলা হয়েছে উলটো। সব ধর্মেই গোলমাল আছে, সবাই ভাবে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে, গিরগিটি যে যেমন দেখেছে সে এই এক রঙের কথাই বলছে, হাতিকে চার অন্ধ চার রকম অনুভব করে চার রকম কথা বলছে, চারঘাটে জল নিতে বসে কেউ অ্যাকুয়া, কেউ পানি, কেউ জল, কেউ ওয়াটার বলছে।

তিনি এক। তিনি নানা হয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ একের কথা বলছেন, কিন্তু একাধিপত্যের কথা বলছেন না। তাই ভয় আর বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে না। তিনি এক, কিন্তু তিনিই নানা। একাধিপত্য মিথ্যা। সৃষ্টির আনন্দ বৈচিত্র্য। সানাইয়ের নানা সুরেই আনন্দ। শুধু পোঁ ধরে থাকা আবার কী?

সব শুনে যদি স্বামীজির মত করে আমিও বলি, আমি এখন নাস্তিক মত পড়ছি। আমি নাস্তিক হয়েছি।

উনি হেসেছিলেন শুনে। বলেছিলেন, সেও হয়। সেও এক পথ। আছে, নেই দুই-ই পথ। ভাব অভাব দুই-ই পথ।

শুধু উদ্বিগ্ন হোয়ো না। কাউকে উদ্বিগ্ন কোরো না। যা জেনেছ তাতেই শান্তিতে থাকো। নিজেকে নিয়ে শান্তিতে থাকলে সবাই এসে পড়ে। ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনিই আসে।