Skip to main content

        এই তো শ্রদ্ধা ছিল। গেল কোথায়? এই তো ভক্তি ছিল। গেল কোথায়? একটা পাখি সকাল থেকে ডাকছে, তোর নাম কি? থাক, নাম জেনেই বা কি হবে! কটা নামই আর মনে থাকল সারা জীবন? এখন শান্ত মনটা। জোয়ার-ভাটা পেরিয়ে গেছে। বড় বড় বজরা বুকের উপর ঢেউ তুলে হারিয়ে গেছে। এখন সব শান্ত। শ্রদ্ধা নেই। ভক্তি নেই। বিশ্বাস নেই। শুধু একটা শান্তি আছে। 
        লক্ষ্মী মানে শ্রী। জানতে? ভুলে গিয়েছিলে? হুম। জানি, কিছু কিছু শব্দের মানে বদলে যায়। সব কিছু বদলে যায়। আজ কাগজে দেখলুম সাদা পায়াজাম পাঞ্জাবী পরা সেই বিখ্যাত কবি ভাসানের উৎসবে রাজাসনের পাশে বসে। তিনি রাজসভা কবি। সেদিন পড়লাম একজন বিখ্যাত লেখিকা বলছেন, দিনে যে কুড়ি হাজার শব্দ লিখতে পারে না, সেকি লেখক? - দৌড়াতে গেলে লম্বা পথে, জিভ বেরিয়ে যাবে হটে। 
        এই কথাগুলো শ্রী নয়, এই দৃশ্যগুলোও নয়। এদের ব্যাখ্যা আছে, সত্য নেই। তবু এই কথাগুলো, এই দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটা ইঙ্গিত আছে। সে ইঙ্গিত বলে, আমাদের লক্ষ্মী নেই, পদ্ম নেই, ধান নেই, আলপনা নেই। এদের অবয়বগুলো আছে, আত্মাটা আর নেই। 
        পাখিটা ডাকছে এখনও। কাকে ডাকছে? নাকি কাঁদছে? নাকি প্রতিবাদ জানাচ্ছে? জানি না। আমার বইয়ের আলমারির সাদা পাঞ্জাবীর ‘কবিতাসংগ্রহ’- রা হাই তুলছে, আমি রাজাসন কোথায় পাই? জানলার বাইরে একখণ্ড নীল আকাশ, ওটা প্রতিশ্রুতি, জানলা আর আকাশের সংসার। জানলায় জাল পড়ে, কপাট পড়ে, আকাশে সাদামেঘ, কালোমেঘ, সূর্য, তারা যাতায়াত করে, তবু অবশেষে একটা প্রতিশ্রুতি থেকে যায়। সে প্রতিশ্রুতি বদলায় না। প্রতিশ্রুতি মনে রাখা মানুষটা বদলে যায়। হাই তুলতে তুলতে পাশ ফিরে শোয়, আকাশটাকে, জানলাটাকে পিছনে রেখে। সে বলে, ভক্তি শ্রদ্ধাকে স্বতন্ত্র হতে দিতে নেই। আগুন জ্বলে। ধোঁয়া হয়। লোকসান হয়। লোকসান হলে কবিতার শব্দরা বিচ্ছিন্ন হয়ে সুষমা হারায়। স্বরযন্ত্রে গানই না, চীৎকারও ওঠে। দাবিয়ে রাখতে হয়, স্লোগান তুলতে সেই জোরকে কাজে লাগাতে হয়। 
        তুমি বলবে তোমার লেখা আমি বুঝলাম না। আমি বলি, আমি তোমার জন্য লিখি না, নিজেকে সুস্থ রাখতে লিখি। আমি সারা পৃথিবী পেরিয়ে যাব বলে হাঁটি না, সুস্থ থাকতে হাঁটি। কোনো মানুষকে আদ্যপ্রান্ত শুষে খাব বলে ভালোবাসি না, সুস্থ থাকব বলে সঙ্গ প্রত্যাশা করি। তুমি সরে দাঁড়াও সাদা পাঞ্জাবি, আমার লাগছে। আমার ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই। আমার শান্তি আছে। 
        এখন আমি দাঁড়িয়ে গঙ্গাতীরে। লক্ষ্মী মাটির মূর্তি হতে শুরু করেছে যখন থেকে তখন থেকে একটা জাহাজের প্রত্যাশা নিয়ে এই গঙ্গাতীরে এসে দাঁড়াই। একটার পর একটা প্রমোদতরী ভেসে ভেসে যায়। ডাকে, কিন্তু সাড়া দিই না। বলি আমার ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই, শান্তি আছে, তোমরা চলে যাও। 
        আমি সমুদ্রের ধারে যেতেই পারি। হেঁটে হেঁটে খালি পায়ে পৌঁছিয়ে যেতেই পারি সমুদ্রের ধারে। কিন্তু এখনই পায়ে বালি মাখতে চাই না, কিছুক্ষণ আরও মাটি লাগুক। তারপর বালিতে মিশে গেলেই হবে। বালির কোনো ধর্ম নেই, প্রত্যাশা নেই, নিজস্বতা নেই। সূর্য তাতালে তাতে, আবার রাত শীতল করলে শীতল হয়। এমন নির্লজ্জ না হলে এতবড় সমুদ্রের ধারে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখে কি করে? মিশে যেত না সেই কবে? আমি এখনই যাব না সেখানে।