Skip to main content
 
 
প্রশ্নটা হল, মানুষের স্বভাবের কি রূপান্তর ঘটানো সম্ভব?
 
       মানুষের স্বভাবকে দুইভাগে ভাগ করা যায় – এক, জন্মগত – যা ইনস্টিংক্ট; আর দুই, শিক্ষার দ্বারা অর্জিত বা অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত। জিজ্ঞাসা হল, জন্মগত যে স্বভাব তার রূপান্তর ঘটানো যায়?
       মানুষের জন্মগত স্বভাব দীর্ঘকালের অভিব্যক্তির সমষ্টিগত রূপ। তা আদিম, অকৃত্রিম, অমার্জিত, বর্বর। যদিও সবটা বর্বর নয়, মানুষের খিদে, তেষ্টা, ঘুম, কামাবেগ, আত্মরক্ষার তাগিদ – ইত্যাদি অবশ্যই নিষ্পাপ। এ সব প্রবৃত্তি মনুষ্যেতর জীব থেকে চলে আসছে। পশুদের মধ্যেও তাগিদ আছে নিজের প্রভুত্ব নিয়ে লড়াইয়ের। গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সেই গোষ্ঠীর নেতা হওয়ার প্রবৃত্তি শিম্পাঞ্জি, হনুমান ইত্যাদি পশুজগতেও আছে। তাদের জগতেও ভাণ করার উদাহরণ আছে। তাদের জগতেও হিংসা, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি আছে। কখনও আত্মরক্ষার তাগিদে, কখনও বা নিজের প্রভুত্ব জাহির করতে – কোনো না কোনো তাগিদে পশুদের মধ্যে যে বর্বরতা তা মানুষের মধ্যেও আছে। কারণ মানুষও পশু – সামাজিক, বুদ্ধিযুক্ত পশু।
       মানুষের স্বভাবের যে দিকগুলোকে রিপু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থাৎ কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ(অহমিকা)-মাৎসর্য(ঈর্ষা) – এই ষড়রিপু কি মানুষের জন্মগত স্বভাবের মধ্যে পড়ছে না? বিশেষ করে প্রথম তিনটে – কাম-ক্রোধ-লোভ। এগুলো মানুষকে কেউ শেখায় না। এগুলো সে নিয়েই জন্মায়। অর্থাৎ, তার জন্মগত প্রবৃত্তি। বাকি রিপুগুলোও তাই। শুধু রিপুই বা বলি কেন? আমাদের সুরক্ষিত থাকার চাহিদা, যার বিপরীত ভয়, এও আমাদের সেই আদিম স্বভাবের আরেক দিক।
       ধর্ম মানুষকে প্রথম বলল, তাকে এই সবের বাইরে যেতে হবে। মূল উচ্ছেদ করতে হবে। পৃথিবীর সবক’টা প্রতিষ্ঠিত, প্রধান, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর মূল কথাই হল – ভালো হতে হবে। স্বভাবের জন্মগত ত্রুটিগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। একজন ভালো মানুষ হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটা ধর্মের মূল কথা এক। কেউ বলল, ভালো হলে স্বর্গে যাবে; কেউ বলল, ভালো হতে পারলে নির্বাণ পাবে; কেউ বলল, ভালো হতে পারলে মোক্ষ পাবে; কিন্তু মূল কথা সবার এক – ভালো হতে হবে। ‘ভালো হওয়া’ মানে জন্মগত স্বভাব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শিক্ষাগত, অর্থাৎ অর্জিত স্বভাবের হাতে নিজেকে ন্যস্ত করতে শিখতে হবে। কয়েকটা মূল কথা যেমন – হিংসা ত্যাগ করতে হবে, মিথ্যা ত্যাগ করতে হবে, করুণা রাখতে হবে।
       এগুলো কি করে হবে? কোনো ধর্ম ধ্যানের উপর জোর দিল, কোনো ধর্ম প্রার্থনা, কোনো ধর্ম সেবা, কোনো ধর্ম নাম-গান, কোনো ধর্ম ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি। এগুলো সবই আমার আদিম স্বভাব থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য নানা অভ্যাস।
       আর ভয়ের কি হবে? আমার আত্মরক্ষার তাগিদ? আমার নিজের অস্তিত্বের নিরাপত্তার তাগিদ? আমার দৈহিক নিরাপত্তাবোধের ভার নানা দেবদেবী থেকে বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে গেল। আমার মানসিক নিরাপত্তার বোধ? না, সেটা বিজ্ঞান দিতে পারল না। তাই সেখানে নানা গুরু, মত, ইজম, প্রতিষ্ঠান, দেশভক্তি ইত্যাদি নানাবিধ বড় কিছুর সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা থেকে গেল। সেদিকে টালমাটাল হলে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। প্রয়োজনে হিংস্র হয়েও উঠি।
       কিন্তু ওদিকে ধর্মের কি হল? দিন যত গেল, তত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিকৃতি এলো, মুখ্য গৌণ হল, আর গৌণ মুখ্য। যে কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন অবশেষে প্রতিলিপি বা রেপ্লিকা বানাতেই শেষে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিম্বা বলা যায় মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে শুধুই আড়ম্বরযুক্ত আনুষ্ঠানিক হয়ে যায়, ধর্মের পরিণতিও তাই হল। অনেকে এসে মাঝে মাঝে মেরামতির চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু কাজ তেমন কিছু হল না।
       কিন্তু কথা হল, এত ধর্ম, এত মতামত, এত বিশ্বাস, এত তত্ত্ব, এত ব্যাখ্যা – এর পরিণাম কি? জগৎ কি হিংসাশূন্য হল? জগৎ কি মিথ্যাশূন্য হল? জগৎ কি নিষ্ঠুরতামুক্ত হল? হল না।
       এরপর এল নানা রাজনৈতিক মতাদর্শ। তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য – সাম্যবাদ। কিন্তু এই সাম্যবাদে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে কি মনে হয় তারা তাদের জনসাধারণের মধ্যে থেকে লোভ-ঈর্ষা-ক্রোধ ইত্যাদি দূর করতে পেরেছে? তারা সবাইকে এমনভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে মানুষ নিজে থেকেই নিজের সম্পদ সবার সাথে ভাগ করে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে এক নীতিতে, এক অবস্থানে থাকতে চাইছে? বলাই বাহুল্য, তা হয়নি।
       অর্থাৎ, এত হাজার বছর ধরে আমাদের ধর্মনীতি আর রাজনৈতিক আদর্শ যা শিখিয়েছে তা মোটের উপর ব্যর্থ, কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা বা ব্যক্তিত্ব বাদ দিলে। আদিম রিপু রয়েই গেছে, শুধু তার সুক্ষ্মতা বেড়েছে, প্রকাশের ভঙ্গী বদলেছে, ক্ষেত্র বদলেছে। বাকি যা তা-ই রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে ধর্মক্ষেত্র সিসিটিভি-র তত্ত্বাবধানে। আমরা জানি ঈশ্বর বা শিক্ষা দুই-ই বেশিরভাগ মানুষের চামড়ার খুব গভীরে যায়নি, যেখানে রিপুর রাজত্ব সেখানে রাবণই রাজা। রাম বড়জোর বৈঠকখানা অবধি পৌঁছাতে পেরেছে। আচরণ অনুকরণ অবধি ঠিক আছে যতক্ষণ সে অভিনয় পরিবেশের অনুকূল। যেই পরিবেশ প্রতিকূল হল, অমনি আচরণ আর অনুকরণ নয়, আচরণ তখন অন্তরের রিপুনিকেতন হেড অফিসের দখলে। চেনা সাধুমানুষ, ভালো মানুষ তখন অচেনা।
       তবে ধর্মে হল না, শিক্ষায় হল না, রাজনৈতিক আদর্শেও হল না। তবে হল কিসে? হল না তো! মানুষের স্বভাবের রূপান্তর তো হল না, তবে কি হল? হল পরিবর্তন। মানুষ আরো বেশি চালাক হল, ধূর্ত হল। সেই চালাকি, ধূর্তামির কিছুটা অংশ সভ্য ব্যবহার, আদবকায়দা, নানা ব্যবহারিক কৌশলাদিতে ঠাঁই পেয়ে গেল। অর্থাৎ এটাও অভিনয়, এটাও চালাকি, এটাও ধূর্তামি – কিন্তু সমাজের জন্য ভালো, তাই স্বীকৃত। মিষ্টি কথা, মিষ্টি হাসি, মিষ্টি ব্যবহার – এ সবই সমাজে স্বীকৃত, অভ্যাসে রপ্ত করে সামাজিক হয়ে ওঠার জিনিস। এ কি আমাদের ধর্ম শেখালো? না। বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি শেখালো? না। আমাদের এতদিনের অভ্যাস শেখালো। আমাদের সামাজিক অভিব্যক্তি শেখালো কোন ব্যবহার আমার পক্ষে আর সমাজে টিকে থাকার পক্ষে মঙ্গল। তাই পুলিশ বাড়ল, আইন কঠিন থেকে কঠিনতর হল, শাস্তির প্রকার বদলালো। মানুষের আদিম স্বভাবের সাথে তার অর্জিত অভ্যাসরপ্ত স্বভাব একটা সমঝোতায় এলো। তার হিংসা রয়ে গেল। তার ঈর্ষা রয়ে গেল। তার প্রভুত্বের চাহিদা রয়ে গেল। তার তীব্র কামলালসা রয়ে গেল। সবই রয়ে গেল। সমাজে এ সব চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেত্রও নির্মিত হল। বিজ্ঞান এসে বলল, এ সবই জীবজগতে পশু থেকে মানুষ হওয়া অবধি অভিব্যক্তির পথের শর্তাবলী, এ অপরিবর্তনীয়, একে কিছুটা বাহ্যিকভাবে উপরসা উপরসা অন্যরকম চেহারা দেওয়া যেতে পারে বড়জোর, কিন্তু একে একেবারে নিঃশেষ করা অসম্ভব। এইভাবে সুর আর অসুরে মিলে তৈরি হল আধুনিক সমাজের ভিত। যা মূলে আদতে সেই আদিম। বাইরে থেকে নানা আভরণে যুগে যুগে সজ্জারূপী খোলসত্যাগী। আবার নতুন সজ্জার পরিধান করে আবার নতুন সাজে।
       এই সমঝোতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মও থাকল। সে থাকল অধুনা আমফানে উৎপাটিত বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটির মত। তার মূল প্রধান কাণ্ডটি যেমন অদৃশ্য। তেমনই তার যে মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ‘ভালো হও আর ভালো করো’ কথাটা, তা সে আজ আর জোর গলায় বলতে পারে না। সে দল গড়ে, ভেদ টানে, ক্ষণে ক্ষণে এর তার উপর চড়াও হতে প্রেরণা যোগায় – মোট কথা সে যাকে উৎখাত করতে সৃষ্ট হয়েছিল, সেই আদিম রিপুরই দাস সে এখন। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছাড়া।
       তবে প্রথম প্রশ্নটা আবার শেষে এসে দাঁড়ালো। মানুষের আদিম রিপুর সেই স্বভাবের কি সম্পূর্ণ রূপান্তর সম্ভব? উত্তরে বলতে হয়, না। তবে যে প্রাচীন সভ্যতার থেকে আধুনিক সভ্যতা অনেক উন্নত, উন্মুক্ত, উদার, তা কি অস্বীকার করি?
হ্যাঁ করি। যেটুকু খোলনলচে বদলেছে তা শুধু বাইরের থেকেই, আপাতদৃষ্টিতেই বদলেছে। ভিতরে ভিতরে সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আজ হয় তো সতীদাহ প্রথা নেই, কিন্তু আজও নির্ভয়ার মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিছু প্রকাশিত, অধিকাংশই অপ্রকাশিত। এরকম উদাহরণ দিতে শুরু করলে শেষ হবে না। তার চাইতে সত্যজিৎবাবুর ‘আগন্তুক’ সিনেমাটাই যথেষ্ট হয় তো।
       তবে উপায়? উপায় একমাত্র মনোবিজ্ঞান। নিজের আচার আচরণ মনোভাব নিয়ে সচেতনতা। নিজেকে নিজের পর্যবেক্ষণে রাখা। এর বাইরে যে শিক্ষাই থাকুক, তা শুধুমাত্রই বাইরের। আমার ষড়রিপু আছে – এ বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানা। আমি নিজেই ষড়রিপু। আমিই রাগ, আমিই লোভ, আমিই ঈর্ষা। তবে নিজেকে স্পষ্ট চেনা যায়। নিজেকে বোঝা যায়। নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যাসটা যায়। নিজেকে মিথ্যা বোঝানোর খেলাটা শেষ হয়। ঈশ্বরের ঘাড়ে, দৈবের ঘাড়ে, সময়ের ঘাড়ে, পরিস্থিতির ঘাড়ে, বংশগত প্রাপ্ত জিনের ঘাড়ে - ইত্যাদি নানা দৃশ্য, অদৃশ্য, কল্পিত কিছুর ঘাড়ে দায় না চাপিয়ে নিজের উপর নেওয়ার অভ্যাস হয়। তখনই কিছু আশার আলো দেখা যায়। ফাঁকি দেওয়ার জায়গা আর অবশিষ্ট থাকে না বলেই হয় তো।