সামনে উৎসব। কিন্তু 'না' বলা যাবে না। বলা যাবে না যে পুজোটা ভারচুয়াল হোক। কিন্তু স্কুল, কলেজ, আদালত, ট্রেন ইত্যাদি সব বন্ধ করে রাখা যাবে। কেন বলুন তো? কারণ পরেরগুলো মানুষের বুদ্ধির সাথে মিশ খায়। উৎসব আর ধর্ম বুদ্ধির সাথে মিশ খায় না, আবেগের সাথে মিশ খায়। যা-ই আবেগের সাথে মিশ খায় তা নিয়েই আমাদের বিপদ। আমাদের বলতে ঠিক কি বোঝাচ্ছি, আমি আপনি? হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আপনি যদি চিকিৎসক হন বা কোনোভাবে স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত থাকেন তবে আমি আপনার কথা বলছি। নতুবা নয়।
দেখুন ক'দিন আগে একটা খবর পড়লাম যে মহালয়ার পর থেকে আবার বঙ্গে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। আসন্ন দুর্গাপুজোতেও বাড়বে। কিন্তু দেখুন তাতে আপনি বা আমি যদি অস্বাস্থ্যকর্মী হই, আমাদের ঠিক কি অসুবিধা বলুন তো? আমাদের আতঙ্ক বাড়বে, নিজের পরিবার-পরিজন এবং অবশ্যই নিজেকে নিয়ে। পেপারে পড়ব। চমকাবো। ভয় পাব। ব্যস এদ্দূর। এর বেশি কিছু হবে কি? না হবে না। বিপদের সামনে মুখোমুখি হবে কিন্তু ওই স্বাস্থ্যসেবীরাই, অবশেষে যাদের উপর আমাদের শেষ ভরসা।
এখন কেউ কেউ বলবেন তোমার ধর্মীয়, উৎসবীয় আবেগ নেই বলে এভাবে ভাবা সোজা হচ্ছে।
কিন্তু আদতে কি তাই? ট্রেন চলবে না, বাড়িতে বসে থাকব, এত এত মানুষের কাজ চলে যাবে, পঠন-পাঠন রীতি বদলে যাবে, প্রায় থমকে যাবে, এমন অনেক মানুষ যারা এই নতুন রীতিকে নেওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের অনেকে আবার আত্মহত্যা করবে – এত এত সব ভাবা কি সোজা ছিল আমাদের মত যাদের ধর্মীয় আবেগ নেই, তাদের পক্ষে? তবু মেনে নিয়েছি। কেন বলুন তো? কারণ নইলে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে। মানুষ রাস্তাঘাটে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ ভয়াবহ দৃশ্য কল্পনা করে।
অথচ দেখুন ধর্মীয় আবেগের বেলায় এ কাজটা করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। কেন বলুন তো? কারণ অন্যান্য আবেগের বেলায় কিছুটা হলেও মানুষের কমোন সেন্সের জায়গা থাকে। ধর্মীয় আবেগের বেলায় তা সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যায়। তাই ধর্মে যেভাবে মানুষকে দিয়ে অনায়াসেই ভালো কাজ আর মন্দ কাজ দুই-ই করানো যায়, অন্য কিছু দিয়ে তা করানো যায় না। কেমন? দাঁড়ান বলছি।
ভালো কাজ। যখন আপনি কাউকে বলছেন যে মানুষের সেবা করলে ঈশ্বরই সেবা পান, এবং মানুষের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর আপনার সেবা চান, এ খুব একটা বড় কথা হয়। এ কথা আমার বুদ্ধিকে নয়, আমার আবেগকে নাড়া দিয়ে যায়। আবেগ সাড়া দিলে আমি আমার সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি সেবার কাজ। সেবার কাজ তখন আমার কর্তব্য না, আমার পুণ্যের কাজ। সমাজে বহু ভালো কাজ এই আবেগের সঞ্চালনে হয়েছে। আজও হচ্ছে।
এইখানে বুদ্ধির একটা অপারগতা আছে। যদি বুদ্ধিকে জিজ্ঞাসা করি যে কেন আমি স্বার্থহীন হয়ে অন্যের সেবা করব, বুদ্ধি কোনো জুতসই উত্তর দিতে পারে না। আসলে আমাদের নৈতিক কর্তব্যগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই যুক্তি ঠিক দিয়ে উঠতে পারে না। কারণ তা নেই। শুধু যদি মেনে নেওয়া যায় এটা কর্তব্য বলেই কর্তব্য, তবে একটা কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা হয়। গীতায় একটা কথা আছে, যদি সম্মান পাবে বলে, বা ফিরে উপকার পাবে বলে, বা মানুষের শ্রদ্ধা পাবে বলে সৎকাজে হাত দাও, তবে তা অর্থহীন। নিঃস্বার্থভাবে যদি করতে পারো তবেই তা ধর্ম। গীতায় আবেগের কথাটাকে উস্কানি দেওয়া হল না। বলা হল নিষ্কাম কাজ করে যেতে হবে। এবং স্বর্গ-নরকের গল্পগুলোও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। যদি নিষ্কামভাবে কাজ করে যেতে পারো তবে বোধবুদ্ধি এমন একটা স্থিরতা লাভ করবে যে মনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। গীতায় একটা দর্শন ও নীতির কথা একই সাথে বলল। পাশ্চাত্যে কান্টের নৈতিক দর্শনও একই কথা বলে, কান্ট বললেন, কর্তব্যের জন্যেই কর্তব্য করার কথা।
কিন্তু ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য যদি আমি সেবার কাজে যোগ দিই, তবে আমার উল্টো দিকে আরেকটা তত্ত্ব দাঁড়ায়, যাকে অ্যাণ্টিথেসিস বলে, ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্যেই তুমি এই সম্প্রদায়কে হত্যা করে ফেলো। এ সম্ভব হয়, কারণ আবেগের মধ্যে গতি থাকে প্রবল, কিন্তু চেতনা থাকে না। কমোন সেন্সকে যখন আবেগের বল ছাপিয়ে যায় তখন মানুষের বিনাশ ঠেকানো খুবই কষ্টকর। কোন পক্ষ কাকে বিশ্বাস করে সে বলা কঠিন। কিন্তু দুই পক্ষই যে আছে সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
এই আবেগ মানুষকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করে শুধু না, ভালো করে তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, মনের মধ্যে নিষ্ঠুর হওয়ার বীজও বুনে দেয়। যে কোনো অথোরিটি মানুষকে ভালোয়েন্ট করে, মানুষকে নিষ্ঠুর করে। মানুষকে অন্ধ করে, যদি সে অথোরিটির কোনো অপরীক্ষিত মান্যতা লাভ করে থাকে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা সংস্থা অথোরিটির ভূমিকা পালন করতেই পারে, কিন্তু সেই যোগ্যতাটা তাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গিয়েই পেতে হয়েছে। কিন্তু যে স্বঘোষিত অথোরিটি মানুষের আবেগের উপর জাল বিছিয়ে বসে থাকে, সে অথোরিটি ক্রমে মানুষকে আবেগপ্রবণ, অসংবেদনশীল, নিষ্ঠুর, অন্ধতার দিকে চলে।
আমি যাকে সেবা করব তাকে মানুষ জেনেই সেবা করব, তাকে ঈশ্বর ভাবার দরকার যখন আমার হবে তখন বুঝব আমার মনের স্বাভাবিক অনুকম্পাবোধ হারিয়ে গেছে বলেই তাকে জাগাতে আমাকে বাইরে থেকে একটা আবেগের ডোজ নিতে হচ্ছে। সেকি স্বাভাবিক? যে মানুষটা স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিদত্ত অক্সিজেন নিতে পারে, সেকি বিছানায় শুয়ে অক্সিজেনের সিলিণ্ডারের নল নাকে গুঁজবে? না তো। তাই যখন বলা হয় অনুকম্পাই ঈশ্বর, তখন তা বুঝি, কিন্তু যখন বলা হয় অনুকম্পায় ঈশ্বর বলে কোনো অতিজাগতিক সত্তা তুষ্ট হন, তখন নিজেকে অপমান করি। লজ্জা দিই। সাথে নিজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জাত শুভবোধকেও।
তবে কি দুর্গাপুজোয় ভিড় হবে না? হবে। মহালয়ার দিন দেখেননি? কেন হবে? কারণ আমাদের ধর্মীয় আবেগ, আমাদের উৎসবীয় আবেগ আমাদের নিষ্ঠুর, অন্ধ হওয়ার ছাড়পত্র দেয়। কেউ তাকে রোধ করতে গেলে প্রলয় বাধে। অথচ সেই মানুষই স্কুল-কলেজ-ট্রেন-আদালত বন্ধ মেনে নেয়, কারণ সেখানে বুদ্ধি তাকে অজ্ঞ, নিষ্ঠুর হতে বাধা দেয়। কারণ সে জানে আদতে সবটা গিয়ে পড়বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর। এত এত চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন আপনার আমার সেবা করতে গিয়ে, সেকি সরকারি ক্ষতিপূরণের ভরসায়? অর্থের জন্যে? না। সেটা কর্তব্য বলে। এটা একটা জীবিকার এথিক্স বলে। নইলে মেডিক্যাল কলেজে যখন শুধুমাত্র কোভিডের রুগী আসছিল, তখন ছাত্রেরা কেন আন্দোলন করেছিলেন যাতে সব ধরণের রুগীকে ভর্তি নেওয়া হয়, কারণ তাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বলে। এই দায়টা, এই এথিক্সটাই একটা জীবিকার প্রাণ। সেটাই তার পরিচয়।
যদি লকডাউন করে জোর করে ধর্মীয় উৎসব আটাকানো যায়, তবে তা গণ-ভাবাবেগে আঘাত করা হয়। আর যদি সে সব বাধা খুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের বিচার-বিবেচনার হাতে ছেড়ে দিয়ে একটা মোটামুটি নিয়ম বেঁধে চালানোর চেষ্টা করা যায়? তবে? আমরা উত্তরটা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের আবেগ আমাদের সেই নির্বোধ আর আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার ছাড়পত্র দেয়, অন্তত বাজারের ভিড় দেখেই তা অনুমান করা যায় কি হতে চলেছে। আশঙ্কা হয় আর কত চিকিৎসককে হারাতে হবে আমাদের নির্বোধ আবেগ-যাপনের জন্য কে জানে।