সৌরভ ভট্টাচার্য
21 December 2016
অবশেষে কি হল? তোমার সেই খেলাটা মনে আছে? দাঁড়াও বোঝাই আগে কোন খেলাটার কথা বলছি। সেই যে গো, অনেকগুলো দাগ অথবা রেখা, তারা কোনো এক বস্তুকে কেন্দ্র করে আঁকা, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ওর মধ্যে একটাই মাত্র দাগ ওই বস্তুটার সাথে লেগে আছে, বাকিগুলো মাঝপথে হারিয়ে গেছে বা শেষ হয়ে গেছে। মনে পড়ল? বা খেলাটা এমনও থাকে, অনেকগুলো গলিপথ আঁকা একটা মাঠের দিকে, দেখে মনে হবে সব গলিগুলোই ওই কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাবে, কিন্তু পৌঁছাতে গিয়ে দেখবে একটা বাদে সব রাস্তাই হারিয়ে গেল মাঝপথে (যেমন ছবিটায়)।
আমাদেরও সেই হাল গো। তোমারও, আমারও। মনে হয় একটা সমস্যা সমাধানের কত না পথই আছে, কিন্তু অবশেষে? একটাই পথ – 'আপন দুটো চরণ ঢাকো'। নিজেকে পাল্টে ফেলো, নিজেকে সরিয়ে নাও, নিজের দাবি-দাওয়াগুলোর মূল্য ছাঁটো। অত মূল্য কেউ দেবে না। সরে আসো ভায়া। বাইরে না, ভিতরে। এইটা একটা চালাকির খেলা। সবাই পারে না। যদি পারলে তো বেঁচে গেলে বলব না, একটু স্বস্তি পেতে পারো এই আর কি। কি রকম? ভিতরে ভিতরে নিজেকে সরিয়ে আনতে হবে, বাইরে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। হাসি, গল্প, ঠাট্টা, মজা ইত্যাদি সব যেমন ছিল চলবে। কিন্তু নিজের ভিতরে সরে আসতে হবে সব দাবি-দাওয়া নিয়ে, বিনা শর্তে।
উঁহু... যদি যুক্তি খাটিয়ে করতে চাও, পারবে না। বাচ্চা পুতুলখেলা ছাড়ে যুক্তির দোহাই দিয়ে না, সে ছাড়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে ওগুলোর মূল্যহীনতা বুঝতে পেরে। এও তেমন, যতক্ষণ তোমার মনে হবে - 'না, আমি তো চেষ্টা করলেই পারি', ততদিন চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে, নতুবা তা ভণ্ডামী হবে, কাপুরুষতা হবে। কিন্তু একটা সময় এসে ওই খেলাটার মত নিজের ঘোর ভাঙে, বুঝতে পারি কত স্বল্প ক্ষমতা আমার। কত দিক থাকে এক একটা ঘটনার আর তারা কত রকম শর্তসাপেক্ষ। তার একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফ্যাক্টর হলুম গিয়ে এই নাম-রূপধারী আমার সত্তাটি। তখন মনে হয়, 'উফ্..., কি অসম্ভব বোঝাই না নিজের ঘাড়ে, নিজের অজ্ঞতাবশে তুলে নিয়েছিলুম। আরেকটু হলেই নিজের চাপে নিজেই মারা পড়েছিলুম আর কি!'
তবে কি আমি খুব বড় একটা বিধান দিতে বসলুম? তা না। সব মানুষের তো আর প্রকৃতি এক না। কেউ শান্তিপ্রিয়, কেউ অহংপ্রিয়, কেউ অলসতাপ্রিয়। এদের এক একজন সমাধানের এক একরকম পথ খোঁজে। তবে বাপু এ তত্ত্ব আমার না, এ তত্ত্বের কপিরাইট আমাগো দ্যাশের দার্শনিকদের। ঠাট্টা নয়, যেটা বলছিলাম। তো যে যার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজবে। একটা গল্প আছে না কথামৃতে, সেই একটা চিল এক টুকরো মাংস মুখে করে বসেছিল। অমনি চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক তাকে ঘিরে হুজ্জুতি শুরু করতে লাগল। তো সে বেচারা আর কি করে, সেই মাংসের টুকরো নিয়ে একবার পুবে, একবার পশ্চিমে এরকম নানান দিকে ঘুরে শেষে 'ধুর শালা মাংসের টুকরো' বলে যেই না মাটিতে ফেলে দিয়েছে, অমনি সব কাক ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ছেড়ে ওই মাংসের টুকরোর দিকে ধেয়ে গিয়েছে। তখন চিলটা নিশ্চিন্তে একটা গাছের ডালে গিয়ে বসল।
এখন কথামৃত থাক। সে গল্প যিনি বলছেন তিনি হলেন গিয়ে পরমহংস মশায়। আমাদের কি আর এরকম গল্প ভালো লাগবে? থুড়ি, এরকম সমাধান ভালো লাগবে? যারা শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির তাদের বেশ ভালো লাগবে। যারা অহং প্রিয়? তাদের গল্পটার ভার্সান কেমন হবে? চিলটা মাংসের টুকরো মুখে করে নিয়ে তো বসেছে। এদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক উড়ে এসে উৎপাত শুরু করে দিয়েছে। তখন সে কি করল? মাংসের টুকরোটা পায়ের নখে আটকে, 'হা রে রে...' বলে কাকের দলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উফ, কি যুদ্ধুটাই না হল... কা কা... কোঁ কোঁ... কত রকম আওয়াজ চারদিকে। একদিকে একা চিল অন্যদিকে হাজার কাক (এই সংখ্যাটা কাস্টমাইজ করে নেওয়া যেতে পারে ইচ্ছা অনুযায়ী)। তিনদিন তিনরাত যুদ্ধ চলার পর একটা সমাধান হল। কিরকম সমাধান? যদি অহংপ্রিয় মানুষটি সাম্যবাদী হন তবে সমাধান হবে কাকের সাথে চিল তার মাংসের ভাগ তুল্যমূল্য বিচারে ভাগ করে নিল। আর যদি পুঁজিবাদী হন, তবে সমাধান হবে, চিলটা কাককূলকে সংহার করে মাংসটা একাই ভোগ করতে লাগল।
আর যদি সে ব্যক্তি অলসতাপ্রিয় হন তবে? তবে তো আরো সোজা! চিলটা মাংসের দোকানে ভিড় দেখে আর ও পথ না মাড়িয়ে সোজা বাড়ি এসে ঘুম লাগিয়েছে। ব্যস, সোজা সমাধানের পথ।
তো কথাটা দাঁড়ালো তাই, আগে মাংস মুখে না নিলে তো আঙুর ফল টকের গল্প হয়ে যাবে। তবে একদিন সত্য সত্যই আঙুর ফলের উপর বিরাগ জন্মায়। তখন মনের মধ্যে অশান্তি থাকে না, দুঃখ অবশ্য থাকে, সে তো থাকবেই। তবে জ্বালাটা থাকে না। অভিজ্ঞতা হিসাবে থাকে, জার্নির একটা পার্ট হিসাবে তাকে মেনে নিতেই হয়। মানুষকে ছাড়া যাব কোথায়? থাকতে তো হবে সবার সাথেই, শুধু একটা চাবি নিয়েই তখন সংসারে চলতে ইচ্ছা করে, যে চাবি দিয়ে শুধু নিজের বাড়ির তালাটাই খোলে। যদিও আগে মনে হত, অনেক তালা খুলতে পারি এই এতগুলো চাবি আমার কাছে আছে। চলতে চলতে একটা একটা করে চাবি খসে পড়তে থাকে হাত থেকে, বুঝতে পারি ওগুলো সব ভুল চাবি ছিল। শুধু একটা চাবিই যেন না হারিয়ে ফেলি, যা দিয়ে অন্তত নিজের বাড়ির দরজাটা খোলে। তাতেই শান্তি।
(ছবি - ইন্টারনেট থেকে ঝাঁপা)