রোম্যান্টিসিজম এ যদি একটা ক্ষতির আশঙ্কা না থাকত তবে শব্দটা মাহাত্ম্য হারাতো। ভয়কে জয় করে নিজের আবেগ, ভালোবাসাতে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার প্রয়াস অথবা সাধনার ভিত্তিই এই রোম্যান্টিসিজম। নতুনকে নতুন ভাবে দেখতে শুধু রুচি লাগে না, সাহস লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে। প্রথা ভেঙে নতুন পথের ভগীরথ হতে শুধু বিচক্ষণতা লাগে না, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় আর প্রাণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লাগে। প্রাথমিকভাবে চারপাশের চূড়ান্ত বিরোধিতা আর অসহযোগিতার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য যা লাগে তা ঔদ্ধত্য না, বীজের অঙ্কুরের মত ঐকান্তিক ইচ্ছা।
রোম্যান্টিসিজম শব্দটা যত নতুন, অনুভবটা তত নয়। তাকে আলাদা করে চিনেছে মানুষের বোধ হয়ত অনেক পরে, কিন্তু তলে তলে তারই প্রেরণায় সে এতটা পথ হেঁটে এসেছে, ঝুঁকি নিয়ে, অস্তিত্ব-সংশয় নিয়ে। সবাই যে সফল হয়েছে তা অবশ্যই নয়। তবু বিফল হয়েও তারা ব্যর্থ হয়নি।
মানুষের ধর্মের উৎপত্তি আর প্রগতির ইতিহাসটাও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। ভয় আর প্রেম এই দুই মেরুর মধ্যে মানসিক অবস্থান আমাদের। দুটোর যে কোনো একটার চূড়ান্ত স্থানে থাকতে গেলেই বিকারগ্রস্থ অথবা মহাপুরুষতুল্য হতে হবে। তবে পুরাণের মহাপুরুষদের বাদ দিলে ঐতিহাসিক মহাপুরুষদের চিত্ত সম্পূর্ণ ভয়মুক্ত এমন প্রমাণ কোথাও মেলেনি। অকুতোভয় - শব্দটা যতটা আভিধানিক, ততটা বাস্তবিক নয়। কারোর অবস্থান ভয়ের দিকে বেশি, তো কারোর প্রেমের দিকে। সেই অনুযায়ী তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। আমাদের সভ্যতার অগ্রগতিতেও একই সূত্রের পদাচিহ্ন। জঙ্গল কিম্বা গুহা সভ্যতার থেকে শুরু করে আধুনিক নগরসভ্যতার গতিপথটাও সেই রেখচিত্রেই। ভয়ের থেকে প্রেমের দিকে এগোনো। জ্ঞান ভয়কে সরিয়ে প্রেমের পথ খুলেছে। জ্ঞানের বিহনে তাই প্রেম নাই, কবির ভাষায়।
দেবতারা ভয়াল ছিলেন। কৃপাটা তাদের প্রেমজ ছিল না, খেয়ালজাত ছিল। সে সব দেবতারা ক্রমে ধর্মীয় অভিব্যক্তির টানে এক পরমাত্মায় লীন হতে থাকলেন। তখনও প্রেম শব্দটা পরিপক্ক হল না। ভয় আর প্রেমের মাঝে একটা শব্দ এলো - শ্রদ্ধা। উপনিষদে যে শব্দটা আমরা পড়ি বারবার। শ্রদ্ধাকে আহ্বান করার মন্ত্রও আছে। অর্থাৎ শ্রদ্ধা পারসনিফায়েড। দেবতারা ক্রমে বিবেকযুক্ত হচ্ছেন যেন। কিন্তু তখনও প্রেম শব্দটা আসেনি। ভক্তি কিছুটা আসব আসব করেও পুরো অর্থে জন্মাতে পারছে না। শ্বেতাশ্বর উপনিষদে যা অনেকটা আধুনিক কালের রচনা সেখানে তার আভাস দেখা গেল।
ভক্তি পূর্ণমাত্রায় এলো পৌরাণিকযুগে। বুদ্ধ কর্ড লাইন ধরে নীতি আর অনুকম্পার উপর ধর্মের ভিত্তি গড়ে দিলেন। যদিও ভক্তি আক্রমণ করল বুদ্ধকে তীব্র বেগে তাঁর প্রয়াণের বেশ কয়েক শতক পরে। স্তব, স্তোত্র তাঁর নামে রচনা হয়ে তাঁকে পুরোদস্তুর ভগবান বানিয়ে তুলল। তবু ভক্তি যেন এখানেও ভয়ের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
ভক্তি আরো এগিয়ে এসে দুটো ভাগে বিভক্ত হল। এক, বৈধীভক্তি। দুই, রাগ-অনুরাগ ভক্তি। এর বীজ গাঁথা হল যদিও ভাগবতে ভারতীয় ধর্মে, কিন্তু বিশ্বের নানান ধর্মে ততক্ষণে সুফী, খৃষ্টীয় মরমীসাধনার পথ তৈরি হতে শুরু হয়ে গেছে।
আমার আলোচ্য এই দ্বিতীয়টা, অর্থাৎ রাগানুরাগ ভক্তি। ভগবানকে ভালোবাসার কথা। নিঃস্বার্থ, ঝুঁকিপূর্ণ, আত্ম-বিস্মরণের মাধ্যমে সেই ঐশী শক্তির সাথে মিলিত হতে অথবা তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করার সাধনা। ভুল বলা হল একটু, ঐশী শক্তি না, ঐশী অস্তিত্ব। অতীন্দ্রিয় অনুভবের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সেই হল জীবনের মূল লক্ষ্য। নইলে মহতী বিনষ্টি - তোমার জীবন ব্যর্থ।
রামকৃষ্ণদেব বিখ্যাত হলেন কিম্বা অনন্য হলেন, তাঁর বহু চর্চিত কালীদর্শনের ঘটনার জন্য কখনও না। কারণ বহু সাধক বলে থাকেন তারা ঈশ্বরের দর্শন, বাণীর শ্রবণ করে থাকেন। রামকৃষ্ণদেব বিখ্যাত হলেন তাঁর সে ঐকান্তিক, জীবনসংশয়ী ব্যকুলতার জন্য। তারপর মুহুর্মুহু সমাধি অতীন্দ্রিয় সত্তার উপর আস্থা মানুষের মনে আরো বাড়িয়ে তুলল। কারণ ভারতীয় মননে অতীন্দ্রিয় অনুভবের প্রতি ক্ষুধা তীব্র। একজন তো তাঁকে সরাসরি সমাধিটা শিখিয়েই দিতে বলল। কিন্তু এই অতীন্দ্রিয়বাদটা কি?
মানুষের সত্তার সাথে রোম্যান্টিক অনুভবের ক্ষুধা চিরকাল। সারা পৃথিবীতে তা নানাভাবে মূর্ত হয়েছে। শিল্পে, সাহিত্যে, দর্শনে, সঙ্গীতে, রাজনীতিতে সর্বত্রই সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এই রোম্যান্টিসিজম এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ধর্মে তার রূপ এলো মিস্টিসিজম হয়ে। মরমীবাদ। ঈশ্বরকে অনুভব করার কথা। তাঁর সাথে একাত্মতা অনুভব করার কথা। মহাপ্রভুর কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণের কালী, কবীরের রাম, তুলসীর রাম (উল্লেখ্য, কবীরের রাম পুরাণপুরুষ না, সে নির্গুণ তথা সগুণ সত্তা, নিরাকার, কারণ কবীর অবতার স্বীকার করতেন না। তুলসীর রাম অযোধ্যার। তিনি পুরাণপুরুষ।), রামপ্রসাদের কালী, মীরার কৃষ্ণ - এই মরমীবাদের সৃষ্টি। কেন এই মরমীবাদের সৃষ্টি? কারণ সে তার একার উপভোগ্য। সবার নয়। সে তাঁদের নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি। রামকৃষ্ণদেবের জীবনে একটা গল্প আছে, তিনি মুড়ি খেতে খেতে আলপথ দিয়ে হাঁটছেন, এমন সময় দেখেন সারা আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায়, আর সেই মেঘের উপর দিয়ে একসারি বক উড়ে যায়। কালো মেঘের বুকে অমন সাদাবকের কন্ট্রাস্টে যে অসামান্য মাধুর্য তৈরি হয়, রামকৃষদেব তাতে মূর্ছিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনাটাই সাক্ষ্য দেয় একজন মানুষের মন কি অসম্ভব তীব্র অনুভূতিপ্রবণ হলে এটা সম্ভব। যে অনুভূতির মূল হল রোম্যান্টিসিজম। তাই এই দক্ষিণেশ্বরের কালী আর রামকৃষ্ণের কালীর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যেমন শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস ফুল গাছপালা নদী ঋতুমালার সাথে রবীন্দ্রনাথের আকাশ বাতাস ইত্যাদির ফারাক।
একি মিথ্যা তবে? হ্যাঁও বটে, নাও বটে। মানুষের সব চাইতে বড় সীমারেখা হচ্ছে সে কোনোদিন মানুষকে ছাড়িয়ে বেশি কিছু হতে পারবে না। হতে চাইলেই তাকে মিথ্যা হতে হবে। মাকড়সা যেমন নিজের সৃষ্টি জালের মধ্যে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকে। ঠিক তেমন মানুষ নিজের মনের মাধুর্যের মধ্যে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকে। তার বেশি যাওয়ার তার জো নেই। তাই মহাপ্রভুর কৃষ্ণ কোনোদিন নিত্যানন্দের কৃষ্ণ নয়, কিম্বা শ্রীজীব গোঁসাইয়ের নয়, যদিও সেই কৃষ্ণের আভাসে তবু সে কৃষ্ণ নয়। তাই রামকৃষ্ণের কালীও বিবেকানন্দের নয়। বিবেকানন্দ আপ্রাণ চাইছেন আমাদের সেই মরমী অনুভবের মোহ থেকে বাস্তবমুখী করতে। সারাটা জীবন যেন উনি স্থির করতে পারলেন না, রামকৃষ্ণ না বুদ্ধ? নাকি এদের মিলিত রূপে কোনো আদর্শ। দুর্ভাগ্য সেটা স্থির করার আগেই তাঁর জীবনবসান হয়। তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, অনূকূলচন্দ্রের অনেক কথা আমি মেনে নিতে না পারলেও এটা অনস্বীকার্য যে উনি এই মোহ থেকে বার করে ধর্মকে একটা সামাজিক সচলরূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন আজীবন। তাঁর ধর্মের সংজ্ঞা হল - পারিপার্শ্বিকের সাথে তোমার নিজের বাঁচা ও বাড়ার প্রয়াসকে ধর্ম বলে। এ দর্শনে উনি সারা জীবন স্থির থেকেছেন এটা বাস্তব। কোনো মানুষই ঈশ্বর ঈশ্বর করে ক্ষেপে উঠলে তাকে দাবিয়ে দিয়ে সমাজমুখী করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
ধর্ম যখনই মরমী তখনই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সমাজ বিমুখ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ 'কথামৃত'। একজন হাস্পাতাল বানাতে চেয়েছিল তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে। রামকৃষ্ণ তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, জীবনের উদ্দেশ্য ওসব না, ভক্তি লাভ করা। ঈশ্বরের কাছে ভক্তি চাও। ওসব ছাড়ো। এ পথ থেকে ধর্মের সংজ্ঞা বদলাতে চেষ্টা করেও সফল হননি বিবেকানন্দ তার স্ববিরোধী বক্তব্যমালার জন্য। অগভীর হয়ে পড়েছে দর্শনের ভিত। অপরপক্ষে বিবেকানন্দের দর্শনকে কিছুটা কাস্টমাইজ করে মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ, আরো অনেক বিপ্লবী তাদের দেশপ্রেমের জ্যোতি জ্বালতে পেরেছিলেন। কিন্তু সে রামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ নয়। সে স্বাধীন বিবেকানন্দ।
অবশেষে এই কথাটাই বলা, আজও বহু মানুষ প্রাণান্ত সাধনা করছেন, ছলের আশ্রয়ে সমাজবিমুখ হয়ে বসে আছেন এই ঈশ্বর অনুভবের ঠেলায়। বাউল বলো, সাধক বলো, শিল্পী বলো, সাহিত্যিক বলো সবই আপন মনের মাধুরীতে মত্ত। সে পথের অনুকরণ হয় না। শিল্প সাহিত্যে বাঁচোয়া হল তা শিষ্য বানায় না। কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় না। যা ফল তা হাতেহাতে। ছবি দেখে তোমার ভালো লাগল, বই পড়ে তোমার ভালো লাগল - ব্যস ওতেই পূর্ণতা। কিন্তু এই যে তুমি অমুক দিকে মুখ করে অমুক শব্দমালা (মন্ত্র) প্রতিদিন ১০৮বার আবৃতি করলে তোমার অমুক অনুভূতি হবে - এতেই গোল পাকলো। কোনো মরমী মানুষের অনুসরণ করে জীবন কাটালে আখেরে জবুথবু হয়ে বাঁচা ছাড়া কোনো পরিণাম দেখি না। সে অনুকরণে সে হয়ত অসম্ভব শান্ত হয়েছে, কিন্তু সে তো তোতাকাহিনীর পাখি হয়ে উঠেছে।
মন মুক্ত হোক। খোলা হাওয়া লাগুক। এসোটেরিক বা মরমী কোনো পথেই যাওয়ার দরকার কি? রোম্যান্টিসিজম থাকুক স্ব-ভাব অনুযায়ী। না থাকলেও ক্ষতি কি? সংসারে কাজের অভাব নেই। মুখোশের বাড়বাড়ন্ততেই ক্ষতি। মানব সম্পদের ক্ষতি।
সৌরভ ভট্টাচার্য
6 October 2017