Skip to main content

যদি শান্তি চাও, দোষ দেখো না – বহুশ্রুত মা সারদার উক্তি বা উপদেশ। কিন্তু... - একটা 'কিন্তু' তবু খচখচ করে। সেটা কি করে সম্ভব? তবে কি উনি মৃত্যুশয্যায় একটা গোলমেলে কথা বলে গেলেন? তা কি করে হয়?


    এ কথাটা বহুবার ভেবেছি। ভুল না ধরলে শুধরাব কি করে? যার যেটা ভুল সেটা তাকে বলব না? সে তো আরো বিপথে যাবে? এরকম নানান তর্ক যুক্তি মাথার মধ্যে ঘোরে।


    আসলে কথাটার অন্য একটা জায়গায় বোঝবার সূত্র আর বলবার হেতুটা আছে। “যদি শান্তি চাও”। এর অর্থ এ নয় যে, অন্যায় অসত্য দেখলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। তখন না বলার জন্য মনটা অশান্ত হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সত্যটা বা ঠিকটা বলতেই হবে।


    কিন্তু আরেকটা দিকও আছে। অনেক সময় দোষ দেখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন মনটা অকারণে হয়তো না, তবে এড়ানোযোগ্য কারণেও নালিশপ্রবণ হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে অসন্তোষে, ক্ষোভে। এ তার মানসিক ও শারীরিক – দুই স্বাস্থ্যের পক্ষেই ক্ষতিকর। কারণ তখন সেটা স্বভাবপ্রসূত, বিবেচনাপ্রসূত নয়। বিবেচনাশক্তি সবদিক সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারে, কিন্তু যখন মনই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল তখন তাকে শান্ত রাখা দায়। হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি – যে কোনো একটাকেও অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলে সে আত্মসত্ত্বাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। প্রথমটা দুর্বল, আবেগপ্রবণ করে তোলে আর দ্বিতীয়টা শুষ্ক তর্কপ্রবণ করে তোলে। দুইই অস্বাস্থ্যকর।


    জগৎটা সর্বাঙ্গসুন্দর নয়। গীতা বলেন, ‘অনিত্যম, অসুখম লোকা’ ... রামকৃষ্ণদেব বললেন, বালিতে চিনিতে মেশানো এ জগৎ, তোমায় চিনিটা বেছে নিতে হবে, গোলমালে ভরা চারদিক, তোমায় ‘গোল’ ছেড়ে ‘মাল’টি নিতে হবে। আর কথাতেই তো আছে, "যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে"। অর্থাৎ, আমি রাম শ্যাম যদু মধু সক্কলেরই এক দশা – ভালো-মন্দ মেশানো প্যাকেজ। তা তিতেটা ছেড়ে মিঠেটা নিলেই হয়, তিতে নেই কে বলল? তবে আমার ও নিয়ে কোনো লাভ নেই, এই কথাটাই মা বললেন। ওতে অশান্তিই বাড়বে।


    একটা গল্প বলে শেষ করি। শিরডির সাঁইবাবার কাছে এক ভক্ত যেতেন। তিনি ভীষণ লোকের নিন্দা করে বেড়াতেন। একদিন সাঁই তার সাথে বিকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছেন, আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। ভক্তটি খেয়াল করলেন, সাঁই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা শূকরের নোংরা খাওয়া দেখছেন। তিনি ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বললেন, ছি ছি একি দেখছেন সাঁই, চলুন এগিয়ে চলি।


    সাঁই একটু হেসে বললেন, দেখ কি সুন্দর নিজের জিভ দিয়ে চেটে নোংরা জায়গাটা পরিস্কার করে দিচ্ছে! ভক্ত বললেন, ছি ছি। সাঁই বললেন, ছি ছি কেন রে, তুইও তো নিজের জিভ দিয়ে লোকের নোংরা চেটে বেড়াস, করিস না এর ওর নিন্দা সারাদিন?
    স্বভাব কি একদিনে যাবে? না যাবে না। তাই ঠাকুর অভিনব প্রার্থনা শেখাচ্ছেন, "যখন ভক্তি প্রার্থনা করবি, সাথে এও প্রার্থনা করবি, মা আমি যেন কারো দোষ না দেখি, কারোর নিন্দা না করি, এমনকি পোকাটারও না।"


    মা সারদা দক্ষিণেশ্বরে প্রার্থনা করছেন কেঁদে কেঁদে, মা আমার দোষদৃষ্টি দূর করে দাও।
    তবেই যে না মা, নইলে যেতুম কোথায়!