Skip to main content


“Goethe মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, Light! More light!... আমি বিশ্বাস করব, অন্যে যা করে করুক; আমি এই দেবদুর্লভ বিশ্বাস কেন ছাড়ব? বিচার থাক। জ্ঞান চচ্চড়ি করে কি একটি Faust (গেটের সৃষ্ট একটা চরিত্র) হতে হবে? গভীর রজনীমধ্যে বাতায়নপথে চন্দ্রকিরণ আসিতেছে, আর Faust নাকি একাকী ঘরের মধ্যে ‘হায় কিছু জানিতে পারিলাম না, সায়েন্স, ফিলসফি বৃথা অধ্যয়ন করিলাম, এই জীবন ধিক্!’ এই বলিয়া বিষের শিশি লইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিলেন!... না, আমার এ সব ভয়ানক পণ্ডিতদের মতো একছটাক জ্ঞানের দ্বারা রহস্য ভেদ করতে যাবার প্রয়োজন নাই। আর একসের বাটিতে চারসের দুধ ধরলো না বলে মরিতে যাবারও দরকার নাই! বেশ কথা – গুরুবাক্যে বিশ্বাস। হে ভগবান, আমায় ওই বিশ্বাস দাও; আর মিছামিছি ঘুরাইও না। যা হবার নয়, তা খুঁজতে যাওয়াইও না। আর ঠাকুর যা শিখিয়েছেন, ‘যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় – অমলা অহৈতুকী ভক্তি; আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’ কৃপা করে এই আশীর্বাদ কর।”


       কথামৃতকার মাষ্টার মহাশয়ের এগুলি স্বগতোক্তি, কথামৃতে লিপিবদ্ধ আছে, ১৮৮৫ সালের ১১ই মার্চ।

       তার ৯ বছর পর, রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে লিখছেন---

“আমি আলো ও বাতাস এত ভালোবাসি! গেটে মরবার সময় বলেছিলেনঃ More light! আমার যদি সে সময়ে যদি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার থাকে তো আমি বলিঃ More light and more space! অনেকে বাংলাদেশকে সমতল ভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না – চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর কোথায় আছে!”

       কথামৃত ও ছিন্নপত্র দুই-ই শিক্ষিত বাঙালির খুব প্রাণের গ্রন্থ। কথামৃতের প্রভাব ও প্রসার স্বাভাবিক কারণেই বেশি, কিন্তু ছিন্নপত্রের প্রভাবও কম নয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কথামৃতকার, রবীন্দ্রনাথের থেকে মোটামুটি বছর সাতেকের বড়। তিনি যখন এই কথাগুলো লিখছেন তখন ওনার বয়েস একত্রিশ। রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথাগুলো লিখছেন তখন তাঁর বয়েস তেত্রিশ।

       বাংলায় দুটো ভাবনার দিক যেন তৈরি হচ্ছে। একজন সনাতন, বিনা বিচারে গুরুবাক্য শিরোধার্য করে চলবার রাস্তায় চলতে চাইছেন। দুই, একজন তাঁর মনের ভাবের সাথে, মনের মাধুরী মিশিয়ে জগতটাকে নিজের ভাবের মাধ্যমে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

       এই কথা বলতে বলতে আমার ত্রিপিটকের একটা গল্প মনে পড়ল। উপাখ্যানটি 'চঙ্কী সূত্র' নামে লেখা, ত্রিপিটকের 'মধ্যম নিকায়'তে---

       একজন ব্রাহ্মণ বুদ্ধের সাথে দেখা করতে এসেছেন। এসে জিজ্ঞাসা করছেন, কেন ব্রাহ্মণেরা বেদের নানা সূত্রকে মেনে চলবে না? সেসব তো মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের দ্বারা রচিত। তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় তো অবশ্যই সেসব মেনে চলা উচিৎ।

বুদ্ধ বললেন, আপনি সেইসব মন্ত্রের সত্য প্রত্যক্ষ করেছেন?

ব্রাহ্মণ বললেন, না।

তখন বুদ্ধ বললেন, আপনার গুরু, বা তার গুরু, বা তার গুরু...

ব্রাহ্মণ বললেন, না।

বুদ্ধ বললেন, এ তো অন্ধ প্রবেণীর মত হল। একজন ধূর্ত মানুষ, কিছু অন্ধকে খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। একজন অন্ধের হাতে লাঠি ছিল, বাকিরা সেই অন্ধের কোমর জড়িয়ে একে অন্যকে অনুসরণ করে চলছিল। এইভাবে কিছুটা নিয়ে এসে সেই ধূর্ত একটা বড় গাছের গুঁড়িকে ঘিরে তাদের গোল করে দাঁড় করিয়ে, প্রথম অন্ধের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নেয়, আর তাকে শেষ অন্ধের কোমর ধরিয়ে দেয়, বলে হাঁটো তোমরা। এইভাবে তারা সেই গাছটা ঘিরে ঘুরেই যায়, ঘুরেই যায়..., অবশেষে বিনষ্ট হয়ে যায়।

এই হল গল্প। বিশ্বাস বড় বিষম বস্তু। সে মিলায়। তর্ক বড় পাজি, সে নাকি দূরেই রাখে। এ-ও সেই গপ্পো। হার কে পাবে? গণেশ মা-কে ঘুরে গলায় হার পরে বসে পড়ল, কার্তিক সারা বিশ্ব ঘুরে এসে দেখল মায়ের হার তার আগেই গণেশ পেয়েছে। কারণ বিশ্বাস। মা-ই জগত। এরপরে আরো যোগ হল, পাপের থেকে মুক্তির উপায় নির্দিষ্ট তিথিতে নির্দিষ্ট নদীতে স্নান। পুণ্যও নানারকমের হল --- গোমূত্র থেকে উপবাস। অর্থাৎ, বিবেক রইল বিবেকের স্থানে, বিশ্বাস এল শর্টকাট নিয়ে। বিচারের পথ সেদিন থেকেই হল বিমাতা। বিশ্বাসই হল মূল। ক'দিন আগে আমাজনে ‘জাস্ট মার্সি’ বলে একটা সিনেমা দেখলাম। সেখানে আমেরিকার অ্যালাবামাতে কোনো সাদা চামড়ার লোক আঙুল তুলে, মাত্র কয়েক দশক আগেই, যদি কোনো নিগ্রোকে বলত, একে দেখেই মনে হচ্ছে খুনি, তবে সাথে সাথেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। এও বিশ্বাস। গায়ের রঙের উপর বিশ্বাস।

       এক ভারত জানে যুক্তি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এক ভারত জানে বিশ্বাসে মাথা নীচু করে নিলে প্রশ্নের মুখে জোঁকের মত নুন পড়ে। যে বিশ্বাসকে স্বীকার করার জন্য প্রমাণ লাগে না, সেই বিশ্বাসকে অস্বীকার করার জন্যও যে প্রমাণ লাগে না, সে তারা মানতে নারাজ। অন্ধ প্রবেণী বয়েই চলে, বয়েই চলে। আমরা অন্ধ জুগিয়েই চলি, জুগিয়েই চলি, জুগিয়েই চলি। জিজ্ঞাসা করি না, আপনি যে আমায় দীক্ষা দিচ্ছেন, আপনি কি আমায় ভালোভাবে চেনেন? আপনি কি নিজে সত্যলাভ করেছেন? আপনি কি আমায় কোনো কাল্টের ভোক্তা বানাচ্ছেন? না সত্যের আলোর দিকে এনে দিচ্ছেন? সত্য কি প্রতিষ্ঠান? অমনি সবাই হাঁ হাঁ করে উঠে বলবে, করো কি? করো কি? ধরো ধরো। কোমর ধরো, আনো গুরুবাক্যে বিশ্বাস।