Skip to main content
মাঝেই মাঝেই ফেসবুকে বন্ধু-আত্মীয়-পরিচিতদের বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেখি। যাওয়ার আগের মুহূর্তের ছবিতে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু বেড়াবার ফাঁকে ফাঁকে যে ছবিগুলো পোস্টিত হয় তাতে তারা অন্যরকম হতে শুরু করে। 
        মনে হয় মানুষের মনের সাথে চামড়ার একটা যোগাযোগ আছে। ছবিগুলোতে দেখি পুরো মানুষটা হাসছে। সে মানুষটা ঘরে যখন হাসে, অতটা গভীর থেকে হাসে না। ঠোঁট যুগলকে ঊর্দ্ধমুখী অর্ধবৃত্ত করলেই তো আর হাসি হয় না রে বাবা! চোখের কোণে একরাশ ক্লান্তি, মুখের বলিরেখায় বিষণ্ণতার কালো ছোপ, এই নিয়ে কি আর অমন হাসা যায়! সেই কেমন এক ধারা হাসি আছে না, যেখানে ঠোঁটদুটোর কোণা একটুও উপরের দিকে বাঁক নেয়নি, তবু তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, 'বাহ্‌, মানুষটা বেশ খুশী আছে।' খুব ভালো বাংলায় বললে যাকে বলে 'প্রসন্নতা'। 
        আমাদের জগৎখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ব্যাস মহাশয় তাঁর প্রথম কাউন্সেলিং-এর বইতে, মানে গীতাতে বলছেন, প্রসন্নতাতেই যত দুঃখের অবসান হয়। কথাটা শুনে দিলীপ রায়ের একটা উক্তি মনে হত। উনি একবার কিছুটা অভিমানে শ্রীঅরবিন্দকে বলছিলেন, “আপনার কথা শুনে মনে পড়ছে একটা প্রবাদ - যদি সোয়ালো পাখি ধরতে চাও, তবে সোয়ালো পাখির পাছায় একটু নুন মাখিয়ে দাও"। কথাটা হল সোয়ালো পাখির পাছাই যদি আমার হাতে আসে তবে কি সোয়ালো পাখিটা অধরাই থেকে যাবে? আমার আবার এই কথাটা লিখতে গিয়ে সেই কথাটা মনে পড়ে গেল, কার মামা না কাকাকে যেন আধখানা কুমীরে খেয়েছিল বলে বাকি আধখানা মরে গেল! তো সে যাক, এসব আলাং তালাং না বকে যেটা বলছিলাম, প্রসন্নতার কথা। 
        বুড়ো হচ্ছি যত, বুঝছি, ব্যাস বাবাজী ঠিক অত কাঁচা কথাটা বলেননি বুঝলেন। বোঝার গোল হয়েছিল। আসলে আমাদের শব্দগুলো ক্রমশঃ ইংরাজী শব্দের পরিভাষা হতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এই যেমন ধরেন কিনা, 'সাধু' শব্দটা। সাধু মানে তো 'monk' না, সাধু মানে যে 'সচ্চরিত্র'। এখন এই 'সচ্চরিত্র' অর্থটাতেও চচ্চড়ি পাকানো হয়েছে। যে সারাজীবন জননাঙ্গের সিল খোলেনি সে-ই সচ্চরিত্র এমনটা ভাবলে তো সেই স্বামীজির কথাটা মনে পড়ে - 'কাপুরুষের আর কি ইন্দ্রিয়সংযম!' হে হে কি কতা মাইরি! 
        তো 'প্রসন্নতা'টা মনে হয় ঠিক happy... gay(পুরোনো অর্থে)... jolly... ইত্যাদি শব্দগুলো যায় না। কি যে ছাই যায়, জানি না। মেলা ইংরাজী অভিধান ঘেঁটেও না। সে যাক। কথাটা হল প্রসন্নতা। একটা অবাধ্য ভালো রাখার চেষ্টা নিজেকে। যাই হোক, আমি আমার মনের স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত হতে কিছুতেই দিতে চাই না। কিছুতেই না। তার জন্যে একটা বিশ্বাস লাগে। একটা সহজ সরল বিশ্বাস, বোকার মত গোঁয়ারের মত স্থবিরতা না। একটা বাচ্চা যেমন বিশ্বাস করে আনন্দে থাকাটাই তার স্বাভাবিক অবস্থা, সেই বিশ্বাসটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া। আনন্দে থাকার জন্য বস্তু লাগে না, শর্ত লাগে না। একটা বয়ে চলার বেগ লাগে।
        এই বয়ে চলার বাইরের কথাটাই বেড়াতে যাওয়া। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ঠাঁইনাড়া। একটু ঠাঁইনাড়া হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কথা হল টাকার যোগান হয়ত সময়ে কুলায় না; সময় হল, তো সাথী মিলল না; সব মিলল তো সুযোগটা ঘটে উঠল না কোনো কারণে। একঘেয়ে চরকি কাটা তবু কাটাতেই হবে। যে করে হোক। মনের খোলসত্যাগ দরকার। সরীসৃপ যেমন জীবনযাত্রায় চলতে চলতে বহু আবর্জনা জমিয়ে ফেলে তার খোলসে, ঠিক তেমন আমাদের চলতে চলতেও বহু আবর্জনা জমতে শুরু করে মনের চামড়ায়। যতই সতর্ক হও না কেন জমবেই জমবে। আরো জটিল কথা হল, সেই আবর্জনাগুলো যে জমছে সে হুঁশও থাকে না। মনে হয় এই তো বেশ আছি। চলার বেগ কমছে, ভাবার ঘোঁট পাকছে, সহজ আনন্দের স্রোত ঘোলা হতে শুরু করছে, আচার-আচরণে উষ্ণতা বাড়ছে - অর্থাৎ খোলস ত্যাগের সময় এসেছে। মনের খোলস ত্যাগ। অভ্যাসের জড়তার থেকে বেরোনোর জন্যে এটা করতেই হবে। তার জন্যে পাহাড়, নদী, সমুদ্রতেই যেতে হবে তার কি মানে আছে? একটা ঘটনা বলি, আমাদের বাড়িতে একজন মানুষ আসেন মাঝে মাঝে যার সংসারে সেই অর্থে সন্তষ্ট থাকার কোনো কিছুই নেই। কিছুই সেই অর্থে পায়নি সে জীবনে। কিন্তু কি কারণে যেন তার অভিযোগ বড্ড কম। আমি যখন এর-ওর-তার অভিযোগে পর্যুদস্ত হতে থাকি, তখন তার দিকে তাকালে বিস্মিত হই। তার কাছেই একদিন শুনেছিলাম, তার ভাষাতেই বলি -“জানো ভাই, আমার যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠে আরো দূরে চলে যাই, হালিসহরে নামি না”। 
        তারপর শুনি কোন স্টেশানের থেকে কিছুটা দূরে বড় একটা মাঠ, আরো দূরে গেলে বড় দীঘি যার উপরে শরৎকালে কাশের ঝালর ঝুলে পড়ে; বড় একটা বটতলা আছে কোনো একটা স্টেশানের থেকে পনেরো মিনিট দূরত্বে মাত্র। সেখানে একটা চায়ের দোকান আছে, সেই চায়ের দোকানের দোকানি একজন গোঁসাই। সে চায়ের মধ্যে মিষ্টি গোলে আর মনের মধ্যে গোলে কৃষ্ণরসের মধু...
        এরকম কত বেড়াতে যাওয়া আছে। অনেক বঞ্চনা, ক্ষোভ, অতৃপ্তি যখন মনের মধ্যে ক্ষতের পর ক্ষত সৃষ্টি করতেই থাকে তখন সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের থেকে দূরে সরে যাওয়া। আর প্রকৃতির থেকে বড় তীর্থক্ষেত্র আছে নাকি? সেখানে ঝরাপাতা, ঝরাফুলের হিসাব কষে কষে বিবর্ণ হয়ে বসে থাকে না কেউ। সেখানেই তো যেতে হবে। খোলস ত্যাগ করতে হবে। উষ্ণতা কমাতে হবে। বিশ্রাম নিতে হবে। প্রসন্ন হয়ে, ল্যাদ খেয়ে নয়।