Skip to main content


(এটা প্রবন্ধ হয়ত না। গল্প তো নয়ই। চারদিকে ব্যক্তিগতজীবনগুলো যখন ক্ষতবিক্ষত  হচ্ছে দেখি, খুব কষ্ট পাই। কিছু করার তো ক্ষমতা নেই, জীবিকা সামলে, যেটুকু পারি লিখতে চেষ্টা করি সারাদিন। অনেকে কথা বলতে চান, আমার ইচ্ছা থাকলেও শরীর আর সময়ে কুলায় না। খারাপ লাগে বুঝি। আমারও লাগে। উপায় নেই যে। 
আমি ভীষণ মুষড়ে পড়ি কারোর আত্মহত্যার কথা শুনলে। তাকে না চিনলেও মনে হয় হয়ত আমারও কিছু করার ছিল তার জন্য। অপরাধী লাগে। একটা মানুষ তার জীবন শেষ করে দেবে? মানতে পারি না। 
        বেশ কিছুটা রাস্তা হাঁটলাম। কিছু অভিজ্ঞতা তো হল। কিছু ঝড়, কিছু মরুভূমি পেরোলাম। সে সবের কিছু কথা লেখার চেষ্টা করলাম। যে ভাবে উতরিয়েছি নিজেকে। জ্ঞান মনে হলে পড়বেন না। উপলব্ধি মনে হলে দেখতে পারেন, যদি কিছু কাজে লাগে।)


আজ ভোরে জানতে পারলাম এক অল্পবয়েসী মহিলা আত্মহত্যা করেছেন, আমাদের পাশের পাড়ায়। একটা বাচ্চা মেয়ে আর স্বামী - এই নিয়ে সংসার। আমি চিনতাম না। আশেপাশে অনেকেই আমায় চেনাবার চেষ্টা করলেন। পারলাম না। আসলে এরকম একটা মৃত্যুর পর আর পরিচয় পেতে ভালো লাগে না। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা হয়, তার থেকে তার উপর একটা উপেক্ষা করার ইচ্ছা জন্মায় - 'কেন হেরে গেল... কেন পালিয়ে গেল...' তবু কষ্টটা থেকেই যায়। 
        অনেকের অনেক সাংঘাতিক রকম লড়াইয়ের কথা ফেসবুক জানায় আমায়, চারপাশের ঘটনারা তো আছেই। যে বিষয় নিয়ে বলব বলে বসা তাতে আসি। আমি দেখেছি, সংসারে সব চাইতে ভীষণ যন্ত্রণা বোধহয় সব চাইতে কাছের মানুষগুলোর উদাসীনতা, অমানবিকতা, স্বার্থপরতা। কথাটা নতুন অবশ্যই নয়। যন্ত্রণাটা তবু পুরোনো হতে চায় না। যে দুর্ব্যবহারটা সে করে চলেছে, তার দুর্ব্যবহারের কথাটা বলব কাকে? কোন আদালতে তার বিচার চাইব? বলতে গেলে নিজের লজ্জা, না বলতে পারলে হৃৎযন্ত্রের চাপ। নানান অসুস্থতা। চাপতে চাপতে সেগুলো মনের মধ্যে নানান রোগের শিকড় তৈরি করতে থাকে অলক্ষ্যে। 
        আমার ব্যক্তিগত জীবনেও দেখেছি, এমনটা হয়। এ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম প্রথম টাল খেয়েও এখন সামলে নিয়েছি। কিভাবে সামলেছি সেই ক'টা কথা একটু বলার চেষ্টা করি। যদি কারোর কোনো উপকারে আসে।


১) আরো আঘাত সইবে আমার
----------------------------------------
প্রথম শর্ত, মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। যে যতটা সেটা অতিক্রম করতে পেরেছে সে ততটা উন্নত শ্রেণীর মানুষ। একটা ফোনের দোকানে ক'টা আইফোন থাকে? একটা হাওড়ায় ক'টা রাজধানী ছাড়ে? আপনার বাগানে যত ঘাস তত বনস্পতি কি থাকা সম্ভব? 
অর্থাৎ এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মৌখিক মিষ্টতার অভাব নেই... "হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল"... স্বামীজির কথা... "তবে পাবে এ সংসারে স্থান"। অতএব, অমন ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষটাই যখন তার আশেপাশের মানুষগুলোর জ্বালাতে জ্বলেপুড়ে মরতেন সেখানে আপনি আমি তো কোন ছার! আপনি ভাববেন ওনারা তো অত উঁচুস্তরের মানুষ, ওনাদের কি আর এসব হত?... দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, খুব ভুল ধারণা... আমাদের থেকে লক্ষগুণ বেশিই হত। প্রমাণ? ওদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো পড়ে দেখুন। কি যন্ত্রণা... কি যন্ত্রণা... কি যন্ত্রণা... মাগো মা...। স্বামীজির মতন অসংসারী মানুষ চিঠিতে লিখে বসছেন, 'জীবনটা আর কি... শুধুমাত্র একটার পর একটা মোহভঙ্গ বই ত নয়!' কথাটা কিন্তু তত্ত্বকথা হিসাবে বলা না, বলা যন্ত্রণার উপলব্ধি থেকে। 
        তবে পেরোলেন কি করে? হ্যাঁ এই হল মোদ্দা কথা। তবে পেরোলেন কি করে? দেখুন, তাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি করেনি। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আপনি আর আমি দুজনেই ঠিক করলাম দিল্লী যাব। আপনি গেলেন প্লেনে, আমি গেলুম ট্রেনে। আপনি যে পথ মাত্র কয়েক ঘন্টায় পাড়ি দিলেন, আমি সে পথ পুরো একটা রাত কাবার করে পাড়ি দিলাম। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ওদের হিল আপটা তাড়াতাড়ি হয় কারণ ওদের মনের গতিবেগ খানিক দ্রুত করে নিয়েছেন ওনারা। এ যেমন সত্যি, পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, যে তীব্রতায় ব্যথা আমাদের হয় ওদের ক্ষেত্রে সে ব্যথা একশোগুণ বেশি তীব্রতায় হয়। পার্থক্য শুধু সেটা অতিক্রমের গতিবেগে। সাক্ষী চিঠিপত্র।


২) সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে
----------------------------------------------
না, কখনও আপনাকে বুদ্ধের মত পোজ দিয়ে সবাইকে ক্ষমা করার কথা বলছি না। প্রচণ্ড রাগ হবে, তেলেবেগুনে জ্বলে যাবেন। আবার সাংঘাতিক অভিমান হবে, মরে যেতে ইচ্ছা করবে, পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করবে, বিবাগী হতে ইচ্ছা করবে। আবার এমন বিতৃষ্ণা আসবে যে খুন করে দিতে ইচ্ছা করবে, ফাঁসি দিতে ইচ্ছা করবে, ভস্ম করে দিতে ইচ্ছা করবে। এ সব অকাট্য সত্য। কিন্তু কোনো ফল নেই। কারণ এর একটাও হবে না। 
        সহজতম উপায় বলি। যা দেখেছি। ধরুন আপনি ইয়ে করতে বসেছেন। মানে বড়োটা। জোর করবেন না। ও নিজের চাপে ক্রমশ নিজেই বহির্দ্বারের দিকে এগোবে। আপনি শুধু অপেক্ষা করুন। বেরোবেই বেরোবে। এও তেমন। ভুলতেও যাবেন না, জোর করে মনে করে কষ্ট পাওয়ারও কোনো দরকার নেই। শুধু মনে রাখতে হবে ঘটনাটাকে ফ্লাশ করব, নিজেকে নয়। আমার দুঃখ, শোক, চূড়ান্ত অপমান এসব আমার, কিন্তু আমি নই। এটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যাই হচ্ছে তা আমি ফিল করছি, কিন্তু আমি নিজে তা হতে যাব কেন? আমি ড্রেন, আমি নদী, আমি আকাশ, আমি সিনেমার পর্দা, আমি রাস্তা ইত্যাদি। আমার উপর দিয়ে যা কিছু যেতে পারে, কিন্তু সেগুলো আমি নই। আমি ড্রেনের জল নই, নদীর জল নই, মেঘ নই, সিনেমা নই, লোকজন-গাড়িঘোড়া নই। আমার উপর দিয়ে যা হয় হোক, আমি তা নই। আমাকে শেষ করার ক্ষমতা নেই কারোর, হ্যাঁ আমার সাজানো সব কিছু তছনছ করে দিতে পারবে, কিন্তু মাটিটা কেড়ে নিয়ে যাবে কে? এটা বারবার মনকে বোঝাতে বোঝাতে মনের মধ্যে একটা বসার জায়গা পাওয়া যায় একটু উঁচুতে। আর উঁচুতে উঠলে যা সহজেই করা যায় তা হল উপেক্ষা। 
        নিজের জন্য এই উঁচু ঢিবিটা আপনাকে বানাতেই হবে। 'একা যদি না পারিস মন, গীতবিতানকে সঙ্গে নে না'। সে-ই বানিয়ে দেবে। 
        এই উঁচু ঢিবিটাকেই কেউ ঈশ্বর বলে, বলে আমায় তুলে নাও... "আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে"। কেউ বলে মনের জোর... ”বহিতে পারি এমনি যেন হয়"। তবে সে সিট পেতে হবেই। 
        এখানে আরেকটা গল্প আছে। রামকৃষ্ণদেবের গল্প। ঝড়ের এঁটো পাতার গল্প। হাওয়া যেদিকে নিয়ে যায় যাক সেদিকেই ভেসে যাওয়ার পথ। অহং-এর প্যানপ্যানানিতে কান না দিয়ে দুপুরবেলা গাছের কোটরে কাঠবেড়ালি দেখার অভ্যাস, রাস্তায় চলা লোকজনের পোশাক-আশাক, বাচ্চাদের হইহুল্লোড়, ইত্যাদি নানান দিকে মনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার অভ্যাস। একে বলে 'জ্যান্তে মরা' অবস্থা। বাইরে মৃতের ভান, ভিতরে আনন্দবাজার। কারণ অবশেষে এটা বুঝতেই হয়, বাইরে একচুল ঘটনা নিয়ন্ত্রণেও আমার হাত নেই, না তো মনের মধ্যে ওঠা নানা বিকারের ওপর, আমার হাত শুধু আমার গুরুত্ব দেওয়া না দেওয়ার উপর। এটাই আমার চয়েস। এমনকি পুরা গীতাখানের শেষেও কৃষ্ণ বলছেন, 'যথা ইচ্ছাসি তথা কুরু'... অর্থাৎ সব বলে থুইলাম, এবার তোমার যা ইচ্ছা করো।


৩) খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
------------------------------------
এই দ্বিতীয় ধাপের মধ্যেই আছে তৃতীয় ধাপের বীজ। শুধু ঢিবিটার উপর বিপদকালে চড়ে বসলেই হবে না। তাকে ধোয়ামোছা করতে হবে। 'আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে'। একে ভালো বাংলায় বলে সাধনা বা অন্তর্মুখ হওয়া - বড় কঠিন শব্দ। সে থাক, বরং ভাবা যাক সম্পূর্ণ নিজের জন্যে একটা জগত বানানোর কথা। সেখানে কারোর প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আমার মুখোমুখি আমি। চলছে অনন্তকালের বোঝাপড়া। বাইরের জগতের ধুলোবালি কিচ্ছু ঢুকতে দেবো না সেখানে। রাতদিন ঘেঁটে থাকার জন্য আমার জন্ম হয়নি, আর না তো এর-ওর মনের মধ্যে শিকড় ঢুকিয়ে রসপানের জন্য, যে তারা দূরে সরে গেলেই নিজের অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সিঁধাবো। কে কি বলল, কে কি সিদ্ধান্ত টানল - এসব কানে পৌঁছালেও প্রাণে পৌঁছাবার পথ বন্ধ হবে তখন। এ নাকউঁচু মদিরা পানের কথা না। সংসারে যা কিছু শূন্য তাই বিপজ্জনক। শুনেছি তো নাকি জমি কিনে বেশিদিন ফাঁকা রাখাও নিরাপদ নয় নাকি আজকাল। কারা যেন পার্টি অফিস খুলে দেয়। তবেই বুঝুন, পার্থিব জমির যদি এই গতি হয়, তবে এমন মানব-জমিন বিনা আবাদে পড়ে থাকলে কি হবে সে সহজেই অনুমেয়। যে পারবে ভাগাড় বানিয়ে ফেলবে। তবে কিনা হল নিজের মত করে নিজের জন্য বাঁচার কৌশল।


৪) বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
---------------------------------------------
বন্ধু। জীবনের একটা মূল্যবান সময় এই সম্পর্কটা তৈরি করতে দিতে হবে। দিতেই হবে। সব বীজে ভালো গাছ হবে না। কয়েকটা পচা, ধুরুন্ধর বেরোবেই। হয়ত অনেকগুলোই বেরোবে। কিন্তু কয়েকটা চারা একদম খাঁটি হবেই হবে। 'বন্ধু' শব্দটা মনের সেই গভীর থেকে বাইরে - সর্বত্র যাতায়াত করতে পারে। শাস্ত্র থেকে গালিগালাজ - সব অনায়াসে শুনতেও পারে, দিতেও পারে। যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু গঠনমূলক, যা কিছু বলপ্রদ তা যদি এই বন্ধু শব্দজাত না হত, তবে স্বয়ং ঈশ্বর থেকে বিশ্বচরাচর একটা প্রকাণ্ড ধোঁকা বই কিছু হত না। কিন্তু তা তো নয়। এ বিশ্ব সংসার বন্ধুশূন্য হয়ে পড়েছে এমন আকাল হয়নি এখনও, যদি না আমি নিজেকে নিজের আগল থেকে বাইরে না আনি। বন্ধুত্বের সাধনায় অহং পালাবার পথ পায় না, মঙ্গল বেরোবার পথ পায় না। কারণ একদিকে গালিগালাজ অন্যদিকে আবদার - দুইয়ে মিলে সে একটা ওয়েসিস বানিয়ে ফেলে। সেই ওয়েসিসের জন্যই তো আরো কয়েকটা সকাল নতুন করে দেখার ইচ্ছা। দেখতেই হবে। সব বলতে হবে। কোনো ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের কথা বলছি না। একদম ঘামের গন্ধ পাওয়া বন্ধুত্বের কথা বলছি, যে আসছে গেট খোলার আওয়াজে, হাঁটার শব্দে, চোখ বন্ধ থাকলে ছোঁয়াতেই টের পাওয়া যায়। সেখানে শুধু কথা হোক। প্রয়োজন আর অপ্রয়োজন - দুইয়ের-ই কথা হোক। বুকের পাথর গলে যাক। ভারমুক্ত হই। আবার চলি। সেই ওয়েসিসে মাঝে মাঝে ঈশ্বরও স্নানে আসেন, যখন অভিমান গলে বন্যা আসে। এটাই বাঁচা। খামোখা মরতে যাবো কেন?
        এসবের পরেও অবসাদ আসবে। বিষাদ আসবে। শুধু মনে রাখতে হবে, ওগুলো জীবনের এক একটা প্যারাগ্রাফ, পুরো বইটা নয়। আর একটা এত মোটা বইয়ের কয়েকটা পাতা না হয় ভুলভাল ছাপা হলই, তা বলে পুরো বইটা ফেলে দেব?!