Skip to main content

মাধ্যমিক শেষ হয়ে গেছে। এখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ার মরশুম শুরু হয়ে গেছে। কোনো কোনো স্কুল নাকি উচ্চমাধ্যমিক পড়াতেও শুরু করেছে বা পড়ানোর কথা ভাবছে এমনও শুনছি।

এই সময়টা মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকের দিকে আসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক অস্থিরতা দেখি বিষয় নির্বাচন নিয়ে। যার বেশিরভাগটাই খুব অগভীর, পরিকল্পনাহীন, "ভালো স্কোরিং", "ওটা পড়তে ভয় লাগে", "এটা ভীষণ সোজা" ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা থেকে আসে।

যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কী নিয়ে পরে পড়তে চাও?

বেশিরভাগেরই উত্তর অজানা। আপাতত একটা সাবজেক্ট কম্বিনেশন হলেই হল। যে সকালে কেমিস্ট্রি নিচ্ছে, সে বিকেলে সেটাকে ছেড়ে নিউট্রিশান নিচ্ছে। যে আজকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে দুদিন পড়ে এলো, সে তারপর বায়োলজি নিয়ে নিল। কেউ ইকনমিক্স আর বায়োলজি নিচ্ছে। আরো সব অসঙ্গত কম্বিনেশন।

কম্বিনেশনে বৈচিত্র্য আসুক। সেটা ভালো। কিন্তু সেটা যদি এটা পড়তে সোজা লাগে, আর ওটা পড়তে কঠিন লাগে, শুধু এইটুকুর উপর নির্ধারণ করে হয়, তবে সেটা সম্পূর্ণভাবেই ভুল দিকে নিয়ে যাবে। আমাকে তো ঠিক করতে আমার আগ্রহ কোনদিকে, কোন বিষয়টা নিয়ে আমি ভবিষ্যতে পড়তে চাইছি।

উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা সেমিস্টার অনুযায়ী করা হবে। ভালো। কিন্তু কাদেরকে নিয়ে করা হবে? যাদের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই জানে না তারা ভবিষ্যতে কি করতে চাইছে। কোনো যথাযথ কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে আপাত ভালোলাগা, না-লাগাকে ভিত্তি করে সাবজেক্ট ধরা ছাড়ার প্রক্রিয়া তো আছেই। গোটা বিষয়টাই ভীষণ অব্যবস্থিত।

আমি বিজ্ঞান পড়াই বলে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেই থেকেই বলছি, বাংলা বোর্ডের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই কিন্তু এই সমস্যাটা বেশি। সিবিএসই, আইসিএসই র ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সমস্যাটা এত প্রবল নয়।

বাংলায় ছেলেমেয়েদের কাছে ডাক্তারি পড়তে পারাটাকে মহার্ঘ্য। ইঞ্জিনিয়ারিং তারপর। আর বাদবাকি সব “ওগুলো আমার দ্বারা হবে না” বলে আসা। এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু তার সংখ্যাটা কম। আমরা প্রতি বছর পড়ছি, কলেজে অনেক সিট ফাঁকা থাকছে, ভর্তি হচ্ছে না। সায়েন্স পড়ার ছাত্রছাত্রী কমে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর সিট ফাঁকা থাকছে।

আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা যারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত তাদের কাছে। কতগুলো বিষয়কে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই।

 

১) বিজ্ঞান বিষয়টা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল বলে আমার বিশ্বাস। কেউ অঙ্ক ছাড়া ফিজিক্স টেকনিক্যালি নিতেই পারে। সেক্ষেত্রে অঙ্কটা আলাদা করে তাকে শিখে নিতে হবে। কিন্তু কতজন সেটা করে? পাঁচটা বিষয় নিয়ে স্কুল আর টিউশান পড়তে পড়তে অনেকের বেলাতেই খুব কম সময় বা আগ্রহ থাকে যে আলাদা করে অঙ্কটা শিখি।

তেমনই কেমিস্ট্রি আর বায়োলজিও। খুব বেশি নির্ভরশীল না হলেও অনেকটাই নির্ভরশীল। বেশ কয়েকটা অধ্যায় পড়াতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় যাদের কেমিস্ট্রি না থাকে তাদের। তাদের শুধু মুখস্থের উপর পড়ে যেতে হয়।

 

২) বিজ্ঞানের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আর আছে নিজস্ব যুক্তির পরিকাঠামো। অঙ্ক তার কেন্দ্রগত। কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি তারই উপর দাঁড়িয়ে। অন্তত এইটাই আমার বিশ্বাস। অনুভব। আমাকে বিজ্ঞানের ছাত্র হতে গেলে আমাকে বিজ্ঞানের এই যুক্তির পরিকাঠামো আর ভাষার সঙ্গে পরিচিত থাকতেই হবে। যদি বিষয়টা নিয়ে আমি সিরিয়াস হই। যদি আমি আমার পড়াশোনার গতিপথ নিয়ে সিরিয়াস হই।

 

৩) এইখানেই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। অনেকেই বর্তমানে অদ্ভুত সব অসঙ্গত কম্বিনেশানে বিজ্ঞান পড়ে। সেটা না হচ্ছে বিজ্ঞান, না হচ্ছে আর্টস। কারণ সে সেই বিষয়ের “ঘরানা”টার সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে না। সে বিষয়টার অন্দরমহলে প্রবেশের ক্ষমতা অর্জন করতে শিখছে না।

 

৪) বৈচিত্র্য আর গভীরতা কি একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে? জ্যাক অব অল ট্রেড হতে গেলে সে মাস্টার অব নান হতে হয়, সেটা খুব কাজের?

আমি বলছি না বৈচিত্র্যপূর্ণ কম্বিনেশান থাকবে না। থাকুক। আমি দর্শন আর ডাক্তারি একই সঙ্গে পড়াই না কেন, কিন্তু সেই পরিকাঠামো, সিলেবাস কি পাচ্ছি? সেটা কতটা বাস্তবসম্মত? আমি তর্কের খাতিরে বলতেই পারি অমুক দেশে হচ্ছে, তবে এদেশে হবে না কেন? কিন্তু অন্য কোনো একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর সঙ্গে কি আমাদের দেশ মেলে?

যা হোক সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু আমার উদ্বিগ্নতার জায়গাটা হল অন্য। এই যে আমরা একটা জগাখিচুড়ি মার্কা কম্বিনেশনে পড়িয়ে দিচ্ছি, তারপর কি হবে? যখন তারা গ্র‍্যাজুয়েশানের দিকে যাচ্ছে তখন আবার আরেক নতুন কম্বিনেশানের নিয়মের মধ্যে এসে পড়ছে। যে অঙ্ক আর ফিজিক্স ছাড়া কেমিস্ট্রি পড়ে এলো এগারো বারো ক্লাসে, তাকে বিভিন্ন কলেজ বলে দিচ্ছে এই কম্বিনেশানে কেমিস্ট্রি নিয়ে স্নাতক হওয়া যাবে না। এইবার? অর্থাৎ তার দু বছর পড়ার আদতে কোনো মূল্য নেই? তার কেমিস্ট্রিতে প্রাপ্ত মান যাই হোক না কেন, এরপর তাকে সে এনে শূন্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।

 

৫) অনেকে বলবেন, দারুণ সব নাম্বার তো পাচ্ছে।

আমার উত্তর, পাচ্ছে। এবং যদি ধরে নিই এই প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতেই আমরা তাদের আহরিত জ্ঞানের একটা সোজা সরল সমীকরণ বানিয়ে ফেলেছি, তবে সে নিতান্তই অগভীর, অনভিজ্ঞ সরলতা। নাম্বার বাড়ানো আর কোনো বিষয়ে নিজের গভীরতা বাড়ানো অনেক সময়েই এক আসনে বসে না। আজকাল তো আরো বসে না। ছাত্র নিজের নাম্বার দেখে নিজেই চমকে যায়, এত পেলাম কি করে! এ ঘটনাও আজকাল বেশিই ঘটছে।

অনেক অনেক নাম্বার। তারপর সেই নাম্বারের ভিড় ঠেলেঠেলে নিজের পছন্দের বিষয় আর কলেজ খোঁজা, ভীষণ কঠিন কাজ। এবং যদি শুরুর দিকে আমার কথাটা মনে রাখেন, যে অনেকেই জানে না তারা কি নিয়ে পড়বে, অগত্যা একটা যা হোক পাওয়া যাচ্ছে সেটা নিয়েই পড়লে হবে, এই হয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ। যারা যে কম্বিনেশনে উচ্চমাধ্যমিক পড়ল, পরে জানল সেই কম্বিনেশনে কোনো বিশেষ এক বিষয়ে অনার্স পাওয়া যাবে না। এবার?

 

৬) এখান থেকেই আমার মনে হচ্ছে, এই যে বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহ, এটা এই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক কম্বিনেশানের জন্য নয় তো? আসলে তো সে এমন একটা বিষয় পড়ছে, যার বেশ কিছুটা সম্বন্ধেই তার ধারণা অস্পষ্ট হয়ে থাকছে কারণ সেই বিষয়টা বোঝার জন্য সাপোর্টিভ সাবজেক্টে তার জ্ঞান নেই বলে। এর দায় কার?

 

৭) বাংলা স্কুলগুলো ধুঁকছে। এ বলাবাহুল্য। এখনও মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় বিজ্ঞানশিক্ষা বাস্তবায়িত নয় আমাদের দেশে। এরই মধ্যে আরেক ধরণের ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজিতে অনীহা নিয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার প্রবণতা থেকে যাচ্ছে।

বাস্তবটা হল, উচ্চতর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাংলা পরিভাষা ভীষণ দুর্বল। এর মধ্যে বেশ কিছু বই ছাপানো হচ্ছে যেখানে বাংলা পরিভাষার পাশাপাশি ইংরেজি টার্ম দেওয়া থাকছে না। এবং ইদানীং নজরে এলো বাংলা বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যমের জীবনবিজ্ঞান বইতে কি ভীষণ সব ভুল বানান আর বাক্য ছাপানো হচ্ছে। কিছুই কি প্রুফ সংশোধন হচ্ছে না? জানি না।

বাস্তবটা স্বীকার করে আমি এখনও অন্তত উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের শুধু বাংলা পরিভাষায় পড়াতে স্বস্তি বোধ করি না। কারণ সামনেই একের পর এক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, সেখানে শুধুমাত্র বাংলা পরিভাষায় উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান, বিশেষ করে বায়োলজি পড়ে গেলে যে কি বিপদ সে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষই জানেন। যদিও অনেকের আপত্তি শুনি, “আপনি শুধু বাংলাতেই পড়ান না”। অভিভাবকদের থেকে আসে এ সাজেশন। হয় তো আমার মফঃস্বলে থাকার জন্য এটা হয়, আর্থসামাজিক কারণে। কিন্তু সব সময় তা নয়ও। কিন্তু বিশুদ্ধ বাংলা পরিভাষায় বিজ্ঞান পড়ানো কি করে যায় আমি এখনও জানি না।

 

৭) অভিভাবকদের অতিসক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তা। এই দুটোই ভীষণ ক্ষতিকারক।

অতিসক্রিয়তা।

এক, কোনো বিষয়ে একদিন, দুদিন ক্লাস করেই বোঝা যায় না সেটা কঠিন না সোজা। তার জন্য ধৈর্য লাগে। দুই, সোজা-কঠিনটা ভীষণ আপাত। আমার আগ্রহ আর কতটা ডিটারমাইন্ড সে ক্ষমতার উপর সেটা নির্ভর করে। সব চাইতে বড় কথা, আমি একই সঙ্গে সব হতে পারব না। আমাকে বেছে নিতে হবে। সে বাছাটা যতটা রিজিনবল হয়ে তত মঙ্গল। নইলে এমনও তো দেখছি, যার পড়াশোনা শূন্যের কাছাকাছি, সে মেধার কারণেই হোক, কি অনাগ্রহের কারণে, তাকেও মা-বাবা ডাক্তার করার জন্য শিক্ষক থেকে জ্যোতিষী সবার কাছে দৌড়াচ্ছেন। অবশেষে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিকল্প রাস্তার জন্য দৌড়াচ্ছেন।

নিষ্ক্রিয়তা।

যা ইচ্ছা করুক। এটা কোনো কাজের কথা নয়। ঠিক তেমনই যেমনটা কোনো একটা বিষয় চাপিয়ে দেওয়াও কাজের কথা নয়। বর্তমানে যে ভয়ংকর আত্মধ্বংসী কম্বিনেশান পদ্ধতি চলছে, সেখানে একটা ঠিকঠাক কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা দরকার। স্কুলের সঙ্গে যুক্ত অনেক সহৃদয় শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যারা এ কাজটা খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। অথবা ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেকে এই ব্যাপারে কিছুটা আলোকিত করে তুলতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে সঠিক মানুষের কাছে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। অবশ্যই সেখানে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকারা আছেন।

যুগ বদলেছে। দ্রুত বদলাচ্ছে। আমি আর কোনো বিষয় নিয়ে বলার যোগ্যতা রাখি না। শুধু বিজ্ঞান নিয়ে বলি। দয়া করে বিজ্ঞান নিয়ে এই ছেলেখেলাটা করবেন না। অসঙ্গত কম্বিনেশনে বিজ্ঞান পড়াবেন না। হয় অন্ধকার, নয় আলো। আধাজ্ঞান ভীষণ ভয়ানক। আমরা যা করি একটু দূরের দিকে তাকিয়ে যদি করি আমার মনে হয় ভালো হয় সেটা। অবশ্যই অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আছে যারা এর মধ্যে থেকেও নিজেদের রাস্তা বার করে নিচ্ছে। আমার উদ্বিগ্নতা তাদের নিয়ে নয়। আমার উদ্বিগ্নতা “যে জন আছে মাঝখানে” তাদের নিয়ে। তাদের সংখ্যাটাই তো বেশি। একটু সিরিয়াসলি ভাবব না আমরা?