সৌরভ ভট্টাচার্য
28 July 2017
সক্রেটিস নেতা ছিলেন, না গুরু ছিলেন, না শিক্ষক ছিলেন? সক্রেটিসের কোনো ধ্যানের মন্ত্র আছে? পূজাপদ্ধতি? নেই। তিনি শিক্ষক ছিলেন। সব শিক্ষকই সঠিক অর্থে শিক্ষক হলে দার্শনিক। যিনি জ্ঞানের অন্বেষণ করেন। আর সেই অন্বেষণের পার্শ্বধারায় স্বতঃউৎসারিত স্রোত হিসাবে জন্মায় শিক্ষকতার তাগিদ। তাই সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল দার্শনিক তথা শিক্ষক।
দেখুন এই ধারায় একটা শিক্ষক ছাত্রের সম্বন্ধ থাকলেও কেউ কারোর স্তব রচনা করেননি, অতিলৌকিক গুণাবলীতে ভারাক্রান্ত করেননি। যীশুর ক্ষেত্রে হল। কারণ তাঁকে বলা হল গুরু। এই 'গুরু' শব্দটার সাথে আমরা ভারতীয়েরা বোধহয় ভ্রূণাবস্থা থেকে পরিচিত। গুরু - যিনি অন্ধকার দূর করেন ইত্যাদি স্তোত্র আজ থেকে কয়েক দশক পিছোলে বোধহয় কোনো ভারতীয়ের ধড়বিহীন মাথাও আবৃত্তি করতে পারত। অন্ধকার দূর হয়েছিল কি? সে বড় কঠিন প্রশ্ন। সমাজের দিকে পক্ষপাত-নির্মম দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, যতজন অন্ধকারের দূরকর্তা এসেছিলেন সে অর্থে প্রায় কিছুই হয়নি। বিবেকহীনতার অন্ধকার আর বুদ্ধিভ্রষ্টতার অন্ধকার দুটোই গ্রাস করে রেখেছিল, বহুলাংশে এখনও আছে। 'অমানবিক' হওয়ার স্বপক্ষে ভারতীয় শাস্ত্র তথা দর্শনের মত শক্তিশালী উপকরণ খুব কম দেশেই মজুত হয়েছে।
একপেশে কথা বলছি? আপনি গ্রন্থের উদ্ধৃতি না দিয়ে চারপাশটা তাকান, স্পষ্ট হবে। অতীতে বহুদেশই অমানবিক আচার-প্রথা দুষ্ট ছিল। কিন্তু যুক্তিনির্ভর শিক্ষার আলোক বিস্তারের সাথে সাথে সে ধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আর এই কথাটা বলব বলেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা। তাদের শিক্ষক ছিল, আমাদের ছিল গুরু। শিক্ষককে প্রশ্ন করা যায়, সংশয় প্রকাশ করা যায়। গুরুকে করা যায় না। এমনকি তিনি বুড়ো আঙুলটা চাইলেও দিয়ে দিতে হয়। এই দ্রোণাচার্য্য-একলব্য প্রসঙ্গ আমার কাছে গর্বের না, লজ্জার। সে যদি সেদিন বুড়ো আঙুলটা দিতে অস্বীকার করত তবে সেদিন থেকে ভারতের চিন্তা-বোধের ধারা অন্যখাতে বইত হয়তো। এরকম অজস্র উদাহরণ ভারতীয় গল্প-পৌরাণিক কাহিনীতে ছড়িয়ে আছে, আদতে যা দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে চলেছে আমাদের। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে এই অসঙ্কোচ, প্রশ্ন দ্বিধাহীন বুদ্ধিবৃত্তের আত্মসমর্পণ। কোনো প্রশ্ন নয়, শুধু আজ্ঞা প্রতিপালন। কিন্তু শিক্ষকের সাথে সে নিঃশর্ত, প্রশ্নহীন সম্বন্ধ নয়। সেখানে শিক্ষকের বোধ-অভিজ্ঞতার সাথে নিজের বোধ-অভিজ্ঞতার যুক্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ সংঘর্ষ। তাতেই গতি, তাতেই উভয়পক্ষের মঙ্গল। ভারতীয় প্রথায় এ ধারা রুদ্ধ। কোথাও কিঞ্চিৎ প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও তা এতটাই ভক্তিপূর্ণ ভয় মিশ্রিত যে বুদ্ধির তীক্ষ্ণ আক্রমণের স্পর্ধা সেখানে নেই। শ্রদ্ধা, নম্রতা ইত্যাদি যুগ যুগ লালিত অতিপ্রিয় শব্দ তথা গুণাবলীর আড়ালে বুদ্ধির ক্ষুরধার গতি নির্জীব মৃতপ্রায়। তাই সেই অর্থে নানান অতীন্দ্রিয় মতবাদের বৈচিত্র্যময় সম্ভারে আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো ভরে থাকলেও, সঠিক অর্থে বিজ্ঞানের পথ কোনোদিন পাইনি। সেদিকে উৎসাহিত করবে কে? কে নীতিকে বাস্তবমুখী, প্রয়োগমুখী করে তুলবার প্রয়াস পাবে? সে তো ঔদ্ধত্য। আমাদের অমুক শাস্ত্রে, অমুক যুগে যাই হয়ে থাক, সমাজের যে ইতিহাস ধারা নিয়ে আসছিলাম, তাতে মাঝখানে বিদেশী শাসন পর্ব না এলে যে কি গতি হত আজ ভাবতে শিউরে উঠতে হয়।
যা কিছু শরীর নিজের সাথে মিলিয়ে নিতে পারে না, তাই ক্রমশঃ শরীরের পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। আমাদের অপ্রশ্নক আনুগত্য তাই করেছে। দ্রৌপদীর নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা থাকতে নেই। সীতার নেই। কোনো নারী চরিত্রের নেই সে অর্থে। হলে সে ব্যতিক্রম। কর্ণের নিজস্ব কণ্ঠ থাকতে নেই। সবাই নাকি নিজের নিজের ধর্মের প্রতি চরম দায়বদ্ধ। এই অসীম দায়বদ্ধতাই ধর্ম, গুণের লক্ষণ। এ তো গেল পৌরাণিক, কাল্পনিক উপাখ্যান। বর্তমানেও কি এর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমরা? না তো। এখনও জ্ঞানে-অজ্ঞানে মাথা বিকোবার জায়গা খুঁজছি না আমরা? গুরু না হোক নেতা?
এইটা আরেকটা বড় ভয়ের দিক। গুরু আর নেতার একটা সংমিশ্রণ ইদানীং সমাজে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ তারা যে শুধু আপনার নিঃশর্ত হৃদয়পদ্মে পূজিত হতে চাইছেন তা নয়। রীতিমতো দল পাকিয়ে, গোষ্ঠী বানিয়ে একজন পুরোদস্তুর নেতাও হয়ে উঠছেন। মানে আরকি আপনার মস্তিষ্কের চলার রাজাও তিনি হবেন। আপনার আবেগ, বিবেকবোধের উদগাতা আর যুক্তি-বুদ্ধির নিয়ামক একজনই হলে আপনাকে আর পায় কে? সব বিষয়ে তিনিই শেষ কথা। আর আপনার 'yes man' সেজে থাকা। আপনার পরকালে কি হবে, সেখানে ঘর বুকিং পাবেন কিনা, আপনার মেয়ের ঠিক কোন বর্ণের ছেলের সাথে বিয়ে দিলে সব দিক থেকে মঙ্গল... আপনার আগাম দিনে কোনো কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, ইত্যাদি সব কিছুর উত্তর তারা জানেন। নেতা-গুরু প্যাকেজ। যদি কিছু অমঙ্গল হয়, সে আপনার অশ্রদ্ধা, সঠিক মাত্রায় ঠিক না করার ভুল। আর যা কিছু ভালো সে তাদের উদ্ভুত বা প্রাচীন ঋষির দেওয়া অমোঘ বিধানের অনুসরণের ফল।
এ উৎপাত যে আধুনিক আমদানী তা অবশ্য বলা ভুল। এ চিরটাকালই ছিল আমাদের দেশে। ইদানীং বাড়ছে। আসলে আমরা ভীষণ কনফিউজড। এত প্রশ্ন মাথায় আসা কি ঠিক, সব কিছুকেই এত objectively বা বস্তুগত করে দেখাতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে না? জীবনে কিছু একটা রহস্য রহস্য, ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা, অধরা অধরা না থাকলে কি ভালো লাগে? হাজার হোক আমাদের একটা সংস্কার আছে না? আমরা কোনো দিনই অমনধারা উদ্ধত নই। যা কিছু প্রতিবাদহীন নম্র আমরা তারই জয়গান গেয়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে খাবার হজম হল না, এদিকে তা মুখ দিয়ে কিম্বা পায়ুদ্বার দিয়ে বেরোনোর অবকাশও পেলো না, তখন তার কি হবে? সে শরীরের মধ্যে আরেকটা শরীর তৈরি করবে। আমার মধ্যে আরেকটা দুর্বোধ্য প্রতিকূল সত্তা। তাকে নম্রতা দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে না চেপে রাখলে চলবে কেন? তার যতই ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অবসাদের কোমল নেশা, পরাক্রমহীনতা থাকুক না কেন, আদতে তো আমরা ভালো মানুষ? নাকি? হ্যাঁ তো।
তাই আমাদের যুক্তিতে আর বিবেকে কেমন অতটা খোলাখুলি সূর্যের আলো সহ্য হয় না। নিজেকে পুরোটা মেলে ধরতে কত সংশয়, কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগে। কুণ্ঠিত হই। ফিসফিস করে বলি, আরে ওসব ওদের দেশে সাজে, আমাদের না। আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে না, আঙুল কেটে ফেলার। তাই আমাদের গুরু চাই। এই আপনি কোনো গুরু চেনেন? আর কিচ্ছু না, শুধু একটু শান্তি চাই ব্যস। আর কিচ্ছু না। যার উত্তরের কোনো প্রশ্ন করা যায় না সেই গুরু। আহা দিন না দাদা খুঁজে। মাথাটা ভীষণ অভারতীয় হয়ে উঠছে দিনদিন। কোন নাক, কোন ইড়াপিঙ্গলা, কোন সাকার নিরাকার, কোন ক্রিয়াযোগ করতে হবে বলুন... জাস্ট শান্তি চাই। শিক্ষক চাই না, গুরু চাই।
এ হেন শান্তি অন্বেষকদের তাই শ্মশানের গৃধ্রের দল খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে। স্লোগান বলি? গুরু যদি বিবেকবোঝা তবে - "ভাগাও গুরু ভণ্ড বেশ, আনো শিক্ষক বাঁচাও দেশ"।
দেখুন এই ধারায় একটা শিক্ষক ছাত্রের সম্বন্ধ থাকলেও কেউ কারোর স্তব রচনা করেননি, অতিলৌকিক গুণাবলীতে ভারাক্রান্ত করেননি। যীশুর ক্ষেত্রে হল। কারণ তাঁকে বলা হল গুরু। এই 'গুরু' শব্দটার সাথে আমরা ভারতীয়েরা বোধহয় ভ্রূণাবস্থা থেকে পরিচিত। গুরু - যিনি অন্ধকার দূর করেন ইত্যাদি স্তোত্র আজ থেকে কয়েক দশক পিছোলে বোধহয় কোনো ভারতীয়ের ধড়বিহীন মাথাও আবৃত্তি করতে পারত। অন্ধকার দূর হয়েছিল কি? সে বড় কঠিন প্রশ্ন। সমাজের দিকে পক্ষপাত-নির্মম দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, যতজন অন্ধকারের দূরকর্তা এসেছিলেন সে অর্থে প্রায় কিছুই হয়নি। বিবেকহীনতার অন্ধকার আর বুদ্ধিভ্রষ্টতার অন্ধকার দুটোই গ্রাস করে রেখেছিল, বহুলাংশে এখনও আছে। 'অমানবিক' হওয়ার স্বপক্ষে ভারতীয় শাস্ত্র তথা দর্শনের মত শক্তিশালী উপকরণ খুব কম দেশেই মজুত হয়েছে।
একপেশে কথা বলছি? আপনি গ্রন্থের উদ্ধৃতি না দিয়ে চারপাশটা তাকান, স্পষ্ট হবে। অতীতে বহুদেশই অমানবিক আচার-প্রথা দুষ্ট ছিল। কিন্তু যুক্তিনির্ভর শিক্ষার আলোক বিস্তারের সাথে সাথে সে ধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আর এই কথাটা বলব বলেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা। তাদের শিক্ষক ছিল, আমাদের ছিল গুরু। শিক্ষককে প্রশ্ন করা যায়, সংশয় প্রকাশ করা যায়। গুরুকে করা যায় না। এমনকি তিনি বুড়ো আঙুলটা চাইলেও দিয়ে দিতে হয়। এই দ্রোণাচার্য্য-একলব্য প্রসঙ্গ আমার কাছে গর্বের না, লজ্জার। সে যদি সেদিন বুড়ো আঙুলটা দিতে অস্বীকার করত তবে সেদিন থেকে ভারতের চিন্তা-বোধের ধারা অন্যখাতে বইত হয়তো। এরকম অজস্র উদাহরণ ভারতীয় গল্প-পৌরাণিক কাহিনীতে ছড়িয়ে আছে, আদতে যা দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে চলেছে আমাদের। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে এই অসঙ্কোচ, প্রশ্ন দ্বিধাহীন বুদ্ধিবৃত্তের আত্মসমর্পণ। কোনো প্রশ্ন নয়, শুধু আজ্ঞা প্রতিপালন। কিন্তু শিক্ষকের সাথে সে নিঃশর্ত, প্রশ্নহীন সম্বন্ধ নয়। সেখানে শিক্ষকের বোধ-অভিজ্ঞতার সাথে নিজের বোধ-অভিজ্ঞতার যুক্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ সংঘর্ষ। তাতেই গতি, তাতেই উভয়পক্ষের মঙ্গল। ভারতীয় প্রথায় এ ধারা রুদ্ধ। কোথাও কিঞ্চিৎ প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও তা এতটাই ভক্তিপূর্ণ ভয় মিশ্রিত যে বুদ্ধির তীক্ষ্ণ আক্রমণের স্পর্ধা সেখানে নেই। শ্রদ্ধা, নম্রতা ইত্যাদি যুগ যুগ লালিত অতিপ্রিয় শব্দ তথা গুণাবলীর আড়ালে বুদ্ধির ক্ষুরধার গতি নির্জীব মৃতপ্রায়। তাই সেই অর্থে নানান অতীন্দ্রিয় মতবাদের বৈচিত্র্যময় সম্ভারে আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো ভরে থাকলেও, সঠিক অর্থে বিজ্ঞানের পথ কোনোদিন পাইনি। সেদিকে উৎসাহিত করবে কে? কে নীতিকে বাস্তবমুখী, প্রয়োগমুখী করে তুলবার প্রয়াস পাবে? সে তো ঔদ্ধত্য। আমাদের অমুক শাস্ত্রে, অমুক যুগে যাই হয়ে থাক, সমাজের যে ইতিহাস ধারা নিয়ে আসছিলাম, তাতে মাঝখানে বিদেশী শাসন পর্ব না এলে যে কি গতি হত আজ ভাবতে শিউরে উঠতে হয়।
যা কিছু শরীর নিজের সাথে মিলিয়ে নিতে পারে না, তাই ক্রমশঃ শরীরের পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। আমাদের অপ্রশ্নক আনুগত্য তাই করেছে। দ্রৌপদীর নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা থাকতে নেই। সীতার নেই। কোনো নারী চরিত্রের নেই সে অর্থে। হলে সে ব্যতিক্রম। কর্ণের নিজস্ব কণ্ঠ থাকতে নেই। সবাই নাকি নিজের নিজের ধর্মের প্রতি চরম দায়বদ্ধ। এই অসীম দায়বদ্ধতাই ধর্ম, গুণের লক্ষণ। এ তো গেল পৌরাণিক, কাল্পনিক উপাখ্যান। বর্তমানেও কি এর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমরা? না তো। এখনও জ্ঞানে-অজ্ঞানে মাথা বিকোবার জায়গা খুঁজছি না আমরা? গুরু না হোক নেতা?
এইটা আরেকটা বড় ভয়ের দিক। গুরু আর নেতার একটা সংমিশ্রণ ইদানীং সমাজে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ তারা যে শুধু আপনার নিঃশর্ত হৃদয়পদ্মে পূজিত হতে চাইছেন তা নয়। রীতিমতো দল পাকিয়ে, গোষ্ঠী বানিয়ে একজন পুরোদস্তুর নেতাও হয়ে উঠছেন। মানে আরকি আপনার মস্তিষ্কের চলার রাজাও তিনি হবেন। আপনার আবেগ, বিবেকবোধের উদগাতা আর যুক্তি-বুদ্ধির নিয়ামক একজনই হলে আপনাকে আর পায় কে? সব বিষয়ে তিনিই শেষ কথা। আর আপনার 'yes man' সেজে থাকা। আপনার পরকালে কি হবে, সেখানে ঘর বুকিং পাবেন কিনা, আপনার মেয়ের ঠিক কোন বর্ণের ছেলের সাথে বিয়ে দিলে সব দিক থেকে মঙ্গল... আপনার আগাম দিনে কোনো কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, ইত্যাদি সব কিছুর উত্তর তারা জানেন। নেতা-গুরু প্যাকেজ। যদি কিছু অমঙ্গল হয়, সে আপনার অশ্রদ্ধা, সঠিক মাত্রায় ঠিক না করার ভুল। আর যা কিছু ভালো সে তাদের উদ্ভুত বা প্রাচীন ঋষির দেওয়া অমোঘ বিধানের অনুসরণের ফল।
এ উৎপাত যে আধুনিক আমদানী তা অবশ্য বলা ভুল। এ চিরটাকালই ছিল আমাদের দেশে। ইদানীং বাড়ছে। আসলে আমরা ভীষণ কনফিউজড। এত প্রশ্ন মাথায় আসা কি ঠিক, সব কিছুকেই এত objectively বা বস্তুগত করে দেখাতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে না? জীবনে কিছু একটা রহস্য রহস্য, ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা, অধরা অধরা না থাকলে কি ভালো লাগে? হাজার হোক আমাদের একটা সংস্কার আছে না? আমরা কোনো দিনই অমনধারা উদ্ধত নই। যা কিছু প্রতিবাদহীন নম্র আমরা তারই জয়গান গেয়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে খাবার হজম হল না, এদিকে তা মুখ দিয়ে কিম্বা পায়ুদ্বার দিয়ে বেরোনোর অবকাশও পেলো না, তখন তার কি হবে? সে শরীরের মধ্যে আরেকটা শরীর তৈরি করবে। আমার মধ্যে আরেকটা দুর্বোধ্য প্রতিকূল সত্তা। তাকে নম্রতা দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে না চেপে রাখলে চলবে কেন? তার যতই ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অবসাদের কোমল নেশা, পরাক্রমহীনতা থাকুক না কেন, আদতে তো আমরা ভালো মানুষ? নাকি? হ্যাঁ তো।
তাই আমাদের যুক্তিতে আর বিবেকে কেমন অতটা খোলাখুলি সূর্যের আলো সহ্য হয় না। নিজেকে পুরোটা মেলে ধরতে কত সংশয়, কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগে। কুণ্ঠিত হই। ফিসফিস করে বলি, আরে ওসব ওদের দেশে সাজে, আমাদের না। আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে না, আঙুল কেটে ফেলার। তাই আমাদের গুরু চাই। এই আপনি কোনো গুরু চেনেন? আর কিচ্ছু না, শুধু একটু শান্তি চাই ব্যস। আর কিচ্ছু না। যার উত্তরের কোনো প্রশ্ন করা যায় না সেই গুরু। আহা দিন না দাদা খুঁজে। মাথাটা ভীষণ অভারতীয় হয়ে উঠছে দিনদিন। কোন নাক, কোন ইড়াপিঙ্গলা, কোন সাকার নিরাকার, কোন ক্রিয়াযোগ করতে হবে বলুন... জাস্ট শান্তি চাই। শিক্ষক চাই না, গুরু চাই।
এ হেন শান্তি অন্বেষকদের তাই শ্মশানের গৃধ্রের দল খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে। স্লোগান বলি? গুরু যদি বিবেকবোঝা তবে - "ভাগাও গুরু ভণ্ড বেশ, আনো শিক্ষক বাঁচাও দেশ"।