একবার আমার এক পরিচিত মানুষের সাথে গল্প করছি, খুব অসুস্থ উনি তখন, দুটো কিডনীই খারাপ। উনি মজা করে বলছেন, “জানো তো সাউথে গিয়েছিলাম চোখের চিকিৎসা করাতে শঙ্কর নেত্রালয়ে। কিন্তু হোল বডি চেক আপ করাতে গিয়ে যখন জানলাম যে আমার কিডনী দুটোই খারাপ এবং তাড়াতাড়ি বদলাবার ব্যবস্থা না করলে মৃত্যু আসন্ন তখন কি আর চোখের কথা ভাবি?” বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন।
এয়ারটেলের বিজ্ঞাপনের বাংলাটা পড়ে হাসি পেয়েছিল। একটা বাক্য ঠিকঠাক গঠিত হয়নি বলে। কিন্তু 'সম্পর্কতা' শব্দটা নিয়ে কিছু সেরকম মনে হয়নি। ওটা অনেকে হাইলাইট করছেন। ওটা নিয়ে অনেক মজাও হচ্ছে। সে সব পড়েও বেশ মজা পাচ্ছি। আসলে আমি দেখেছি অনেকেই, আমি নিজে তো বটেই, 'সৌজন্যতা', 'দারিদ্র্যতা' এরকম আরো কিছু শব্দ বলে বা লিখে ফেলি। তারপর কেউ কেউ বলেন, অমনি ঠিক করে ফেলি। কিসের একটা ফ্লো-তে বলে ফেলি তা জানি না। তবে আমার মত অনেকেই বলেন দেখেছি, অবশ্যই যারা আমার মত বাংলা ব্যাকরণে নিতান্ত দুর্বল তারাই করেন। ইংরাজিতে যেমন disbalance শব্দটা। আমি লিখতেই তলায় লালদাগ দেখাল, অর্থাৎ কিনা অভিধান বহির্ভূত শব্দ। কথাটা যে imbalance তা অন্যকে ঠিক করে দেওয়ার মধ্যে আমি বেশ একটা আত্মপ্রসাদও লাভ করি মনে মনে। যদিও জানি বক্তা কি বলতে চেয়েছে এবং সে নিজেও সেটা বুঝেছে যে আমি বক্তব্যটা বুঝেও ওকে ঠিক করে দিচ্ছি। কারণ যদিও ভাষার প্রথম প্রয়োজন মনের ভাব প্রকাশ, তা হলে কি হবে, একটা শৈলী তথা নিয়ম আছে না? যতই সেটা গৌণ হোক না এখন সেটাই মুখ্য। যেমন এককালে পোশাক পরিধান করত মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য। এখন লজ্জা নিবারণ গৌণ হয়ে গেছে, এখন তার অলঙ্কার, তার রকমই প্রধান। তা এরকম তো কত কি-ই পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, যাবেও।
তো যে কথাটা বলছিলাম, এয়ারটেলের বিজ্ঞাপনটা। আচ্ছা একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখবেন, গুগুল ট্রান্সলেটে হিন্দীটা যত ভালো অনুবাদ হয় ইংরাজী থেকে বাংলাটা তত ভালো হয় না। এমনকি গুগুল সার্চে কোনো একটা শব্দ লিখলে প্রথম সার্চেই যে অপশানটা আসে সেটাতে একটা অনুবাদের জায়গা থাকে, তাতে হিন্দীটা প্রায় সব শব্দের সাথে আসে, কিন্তু বাংলাটা আসে না। এটাই বলতে চাইছি।
আমরা আমাদের ভাষা নিয়ে যতই রক্ষণশীলতা রাখি না কেন, প্রয়োগশীল না হলে বাঁচব কি? বলে রাখি এই 'প্রয়োগশীল' শব্দটা কিন্তু অভিধানে পেলাম না। তবু যা বলতে চাইছি তা বোধহয় বোঝাতে পারছি। দৈনন্দিন জীবনে কতটা জায়গা আমার ভাষাটার? কর্মক্ষেত্রের কথা থাক। সেখানে সর্বভারতীয় স্তরের কথা আলাদা। কিন্তু কতজন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে শুদ্ধ বাংলায় নিজেকে রাখা সম্ভব বলে ভাবতে পারেন? অসম্ভব। কারণ আমাদের ভাষার প্রয়োগের দিকটা ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ হতে শুরু করেছে এই টেকনোলজীর যুগে। কতজন নিজের মোবাইলটা বা ফেসবুকটাতে বাংলা মাধ্যম করে রাখেন। এক যদি না তার আদর্শগত কোনো দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু সেটা তো আলাদা কথা। যেমন ধরুন আমি বায়োলজী পড়াতে গিয়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হই। এক একটা বইতে এক একটা বাংলা টার্ম। spermathica কোথাও হচ্ছে শুক্রধানী তো কোথাও শুক্রাধার তো কোথাও শুক্রথলি। মানে এক, কিন্তু পরিভাষা আলাদা। আমাদের সে সদিচ্ছা নেই যে একটা বোর্ড গঠন করে পরিভাষাগুলোকে এক রকম করতে। আরো দেখুন, আপনি একটা ইংরাজী ভুল লিখুন, কি ভুল বানান লিখুন, অমনি তলায় লালদাগ চলে এসে সতর্ক করে দেবে আপনাকে। কিন্তু বাংলায় খুঁজতে যান, পাবেন না। আমরা অত খাটব কেন? আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছে... বিবেকানন্দ আছে...
আমি ভুল লেখা বা বলাকে সমর্থন করছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার উপরের ওই গল্পটার মত, যে ভাষাটা মরতে বসেছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্তর থেকে জীবনের, প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, সেখানে একটা কোম্পানীর বিজ্ঞাপন আর কি করবে? ভাষাটাকে আরো প্রযুক্তির সাথে যোগ না করতে পারলে, আরো সহনীয়, নমনীয় না করতে পারলে টিকে থাকব কি করে? প্রযুক্তির সাথে যারা যুক্ত তাদের মধ্যে আরো 'অভ্র'-র সৃষ্টিকর্তার মত মানুষ না আসলে সমস্যা। আরো পরিভাষা চাই। আরো বাংলার ব্যবহার চাই। নতুন শব্দ চাই-ই চাই। ভাবের তাগিদে ভাষা তৈরি হয়। কিন্তু হাতের কাছে সেই বাইরের কোম্পানীর বস্ত্র পেলে কে আর খাদি পরতে চাইবে? তখন রক্ষণশীলতা ছাড়া আর তো কোনো গর্বের জায়গা বেঁচে থাকে না। যে গাড়ি চলার গৌরব হারিয়েছে তাকে মিউজিয়ামে না রাখলে, ক্ষণে ক্ষণে তার হৃত গৌরব স্মরণ না করলে যে তার মান রাখা দায়। তাই কি ভবিতব্য হতে চলেছে তবে? নিশ্চই না। ভেঙে গড়তে হবে। গড়তে গেলে ভাঙতে হবেই। কিন্তু শুরুতেই ভাঙার মধ্যে গড়ার তাগিদটা গড়ে নিতে হবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই হবে। সেই সাচ্চা তাগিদটাই নতুন চলার শক্তিতে ঝাঁপাবে। আর চলমান বস্তুর শুদ্ধতা নিয়ে কেউ ভাবে না। বেডসোরের কথা ভাবব কেন যদি ভাষাটা হেঁটে চলে বেড়ায়? বালাই ষাট!
সৌরভ ভট্টাচার্য
14 July 2017