Skip to main content
অনেক মানুষের জঙ্গলে একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হয়, কোথায় যাচ্ছি? জীবনগুলোর কিছুটা সময় রাস্তার যানজটে, কিছুটা কর্মক্ষেত্রে, কিছুটা শপিং মলে, সিনেমা হলে, পার্টিতে আড্ডায় টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উজ্বল আলো, ঝাঁ চক চক রাস্তাঘাট, কায়দাকানুনের ফিরিস্তি, এসবের মধ্যে মানুষটা কই? টাকা প্রয়োজনের আঙিনা ছাড়িয়ে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আজ। কল্পনা বাস্তবের মাটি ছাড়িয়ে নিয়ন আলোতে পোকার মত আটকে। শিকড়ে জোর নেই বলে ঝুরিতে নির্ভর বেশি। সম্পর্ক টান হারিয়ে প্রয়োজনের হিসাব মেলাচ্ছে। প্রয়োজন বিলাসে সীমা হারিয়েছে। চোখে মুখে গভীর অবসাদের লক্ষণ তীক্ষ্ণ। অবসাদ যত তীক্ষ্ণ, আস্ফালন তত তীব্র।
এ ভাঙবে। আজ না হয় কাল। এর মূলে মিথ্যা। মানুষ সবকিছুর শেষে মানুষই। মানুষ জন্মায় মানুষের মত, তাকে মারা যেতে হয় মানুষের মতই। মাঝে সে নিজেকে যাই সাজাক, যাই বানাক। অর্থ, উচ্চাশা কোনোদিন তাকে নিজের গুরুত্ত্ব বুঝতে দেয় না। সে সবসময় জানে ক্ষমতাই শেষ কথা বলে। অর্থ তাকে ক্ষমতাবান করে অনেক কিছুর। দামী কথা। কিন্তু যতক্ষণ তা প্রয়োজন মেটায় তা ভাল, কিন্তু যেদিন সে আমার যোগ্যতার বেশি ক্ষমতা যোগায় সেদিন আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।
মানুষকে অস্থির করবার সবচাইতে সহজ উপায় তাই, তাকে তার যোগ্যতার বেশি পাইয়ে দাও, স্বপ্ন দেখাও। সে তোমার গোলাম হয়ে যাবে। যোগ্যতা অর্থে আমি শিক্ষাগত, কর্মগত যোগ্যতার কথা বলছি না। বলছি ভোগ করার, সঞ্চয় করার যোগ্যতার কথা। আমার চারপাশ কি আমার এই জীবনযাত্রার যোগ্যতা দেয়? আমার পাশের বাড়ির মানুষটা যেদিন দুটো সিদ্ধভাত আধপেটা খেয়ে, দুটো অর্ধভুক্ত শিশুকে নিয়ে শুতে যায়, সেই রাতে কি আমার বিনোদাগারে বসে আমোদলীলায় ভাসার যোগ্যতা আসে? আমার সে আমোদাগারে ঢোকার সমস্ত সামাজিক ক্ষমতা থাকলেও, আমার মানবিক যোগ্যতা কি আছে?
না নেই। আর এই মানবিক যোগ্যতা এমন একটা শব্দ আমার আজ উচ্চারণ করতেও লজ্জা করে। মনে হয় এই বলবে, এ কোনো রাজনৈতিক পার্টির ম্যানিফেস্টো, নাকি কোনো ধর্মের সেই বস্তাপচা বাণী!
খুব কঠিন এই শব্দটার হয়ে লড়া। কারণ একে শেখানো যায় না। পড়ানো যায় না। এর মাপকাঠি হয় না। এর পরিসংখ্যান বার করা যায় না।
ইদানীং Stanford University একটা বিশেষ বিভাগ খুলেছেন, যার মূল একটা শব্দ Compassion - অনুকম্পা। তাঁরা এই নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্বের বড় বড় মানুষদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন যাঁরা এই পথে কাজ করে চলেছেন বহু বছর ধরে।
সমাজে সব মানুষের ক্ষমতার মান সমান না। দুর্বলের সাথে, পিছিয়ে পড়া মানুষের সাথে সমাজের বেশি সক্ষম, সুবিধাভোগী মানুষের পার্থক্যের প্রাচীর ভাঙতে পারে এবং ভেঙে চলেছে এই একটাই শব্দ - অনুকম্পা। বিখ্যাত দার্শনিক আর্ণল্ড টয়েনবি এক বইতে বলছেন, যদি বলি মানুষকে ভালোবাসো (Love) তবে তার অর্থ স্পষ্ট হয় না, যদি বলি অনুকম্পা (compassion) রাখো, তবে তার অর্থ স্পষ্ট হয়। খুব দামী কথা।
আমাদের চলতে ফিরতে সারাদিনের রুক্ষতার, শুষ্কতার মূলও এই, অনুকম্পাহীনতা। তা আমার বোধের সীমাকে ঘোরে আচ্ছন্ন করে। ওই যে বললাম, যোগ্যতার হিসাব থাকে না। লোভের সবচাইতে বিপজ্জনক দিকই হল সে তুচ্ছকে অপরিহার্য করে দেখাতে পারে। তখন খাদকেই উপবনসদৃশ মনে হয়। নির্বিচারে পা দিই। মুখ থুবড়ে পড়ি। এ পরিণতি স্বাভাবিক। কারণ বিচারের আগেও যা কাজ করে তা সংবেদনশীলতা। সংবেদনা তখনই জাগে যখন চেতনার প্রকাশে কোনো বাধা নেই। লোভের মত চেতনার বাধা আর কি আছে? গীতা বলেন, - লোভ উপহৃত চেতনা... লোভে অবলুপ্ত চেতনা।
একটা গল্প শুনেছিলাম। একবার কেউ একজন ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখা এত বই তো পড়া সম্ভব না আমার পক্ষে, দয়া করে বলবেন এই আঠারোটা পুরাণ, এত শাস্ত্রের সার কি?
ব্যাসদেব বলেন, সর্বশাস্ত্র পুরাণেষু ব্যাসস্ব বচনদ্বয়ম / পূণ্যায় পরোপকারায়, পাপায় পরপীড়ানাম। (সমস্ত পুরাণ, শাস্ত্রের মূল হল, পরোপকার হল ধর্ম, পরের পীড়নই পাপ।)
তুলসীদাস বলেছেন, দয়া ধরমকে মূল হ্যায়, পাপ মূল অভিমান / তুলসী দয়া না ছোড়িয়ে, যব তক ঘটমে প্রাণ (দয়া সব ধর্মের মূল, অহমিকা সব পাপের মূল। হে তুলসী তুমি দয়া ছেড়ো না যতক্ষণ শরীরে আছে প্রাণ।)
সব ধর্ম, সব সাহিত্য, সব সৃষ্টির মূল এই একটা শব্দকে ভিত্তি করেই - অনুকম্পা। আমাদের সবচাইতে বড় ক্ষমতাই হল একে অপরকে অনুভব করার ক্ষমতা। তাতেই আমার চারপাশটা আমার চারপাশ হয়ে ওঠে, পাঁচিল হয়ে ওঠে না।