কোনো মানুষের সঙ্গে, কি পরিবেশের সঙ্গে যত সহজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা যায়, তত সহজে আপন হওয়া যায় না। না তো সে মানুষ, সে পরিবেশ আমার আপন হয়, না আমি হই তার আপন।
আসলে এই আপন হয়ে ওঠা আর আপন করে নেওয়ার মধ্যে একটা পূর্বশর্ত থাকে। এক একটা মানুষ এক একটা ধাঁচের হয়। সে চাইলে, চেষ্টা করলে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে তাই, কিন্তু আপনবোধটা আপনি না এলে তাকে জোর করে জন্ম দেওয়া যায় না।
আমাদের ধর্মে ইষ্ট নির্বাচন বলে একটা প্রথা আছে। সেখানে গুরু শিষ্যকে প্রশ্ন করেন, তোমার কাকে নিজের বলে বোধহয়? মানে ঈশ্বরের কোন রূপকে তোমার আপন বলে বোধহয়?
এই তত্ত্বটা বেশ। এর গভীর সত্যটা হল, যাকে আপন বলে বোধ হবে, তাকে শুরু থেকেই আপন বলে বোধ হবে, সেখানে অভ্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। রামকৃষ্ণদেব একটা গান গাইতেন,
"মনের মানুষ হয় যে জনা, ও তার নয়নেতে যায় গো চেনা,
ও সে দুই-এক জনা, ভাবে ভাসে রসে ডোবে"
যে গান শিখতে চায় না, সেও দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে সুরে-স্বরে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু গানকে কোনোদিন নিজের বলে বোধহয় না। বড়জোর বলে, এখন আগের থেকে ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালোলাগাটার মধ্যে একটা ফাঁকি থেকেই যায়। কোনো বিকল্প রাস্তা না থাকা, অপশানলেস হয়ে যাওয়া… এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনে একটা কিছু আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়ার তাগিদ জন্মায়। সেখান থেকেই সে এই "ভালোলাগা" কে খুঁজে বার করে। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি বিকল্প রাস্তা খোঁজাটা চলতেই থাকে, নিজের অজান্তেই। কারণ সে মনের ভিতরে ভিতরে তো জানেই তার এই 'ভালোলাগা' আপাত ভালো লাগা, এ একধরণের সমঝোতা নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে।
নিজের উপর স্বাভাবিক বিশ্বাস না থাকলে আপনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে মানুষের কথায় কথায় ভয়, সে সারাদিন নিরাপত্তার খোঁজে পাগল হয়। নানা কৃত্রিম নিরাপত্তার আড়ালে আবডালে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। তার ক্ষোভের শেষ নেই, ঈর্ষার শেষ নেই, সন্দেহের শেষ নই। ভয় যতক্ষণ বুদ্ধিকে চালায় ততক্ষণ বুদ্ধির স্বাবলম্বী হওয়ার জো নেই। ততক্ষণ তার অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতারও শেষ নেই। যেই সে আপন হয়ে ওঠার সত্যিটাকে খুঁজে পেল, অমনি সে নিজের হাত থেকে নিজে ত্রাণ পেল।
বুদ্ধি যখন মোহমুক্ত হয়, তখন ভয়মুক্তও হয়। গোটা জীবনে অন্তত কয়েক মুহূর্তও যদি এই মুক্তাবস্থার অভিজ্ঞতা হয়, সে বুঝতে পারে সে যাতে অভ্যস্ত হয়ে আছে সে তার আপন ক্ষেত্র না। সে বুঝতে পারে তার আপনজনকে, তার জীবনের আপনক্ষেত্র কোথায়! নিজের জীবনে নিজেকে পরবাসী করে আর বাঁচতে হয় না। সত্যিকারের শান্তি তার জীবনে আসে। জীবনে দায়িত্ব-কর্তব্য পার করে নানারকম সৃষ্টির রাস্তা খোলে। নিত্য দিনের সাধারণ কাজকেই সে অন্য আলোতে আরো স্পষ্ট করে দেখে। সে অনুভব করে যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নেই, যতক্ষণ না আপন জায়গার সন্ধান জীবনে পাওয়া যায়। তখন আর ভান করে, নিজেকে সুখী প্রমাণ করে বাঁচতে হয় না। কারোর কাছেই কিছু প্রমাণ করার দিন শেষ। এখন শুধু নিজের সঙ্গে নিজের জায়গায় আপন হয়ে বাঁচা। তখন নানা ওঠাপড়া সুখদুঃখকেও আর অতিরিক্ত, অবহ মনে হয় না। সে সবও নিজের বলে মনে হয়। তবেই না আলো-অন্ধকারের রাস্তায় হাঁটার সার্থকতা আসে, জীবন ভরে ওঠে! সেকি ফাঁকি দিয়ে হয়? না ভয় আর লোভের দাসত্বে হয়?! ভয় আর লোভের চিরকালের শাগরেদ চাতুরী। চাতুরীতে গোটা বিশ্বসংসারের রাজাও হয় তো হওয়া যায় কিছুকালের জন্য, কিন্তু নিজের পায়ের তলার সত্যিকারের মাটি অধরাই থেকে যায়। ভয় আর লোভের থেকে ত্রাণ না চাইলে রাস্তা পাওয়া শক্ত, নিজেকে পাওয়া দুরূহ। এ সত্যটা যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করে নেওয়া যায় তত সময়ের অপচয় কমে। নইলে ওই গানে আছে,
তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া
তাই ভয়ে ঘোরায় দিক্বিদিকে,
শেষে অন্তরে পাই সাড়া ॥
যখন হারাই বন্ধ ঘরের তালা--
যখন অন্ধ নয়ন, শ্রবণ কালা,
তখন অন্ধকারে লুকিয়ে দ্বারে
শিকলে দাও নাড়া ॥
যত দুঃখ আমার দুঃস্বপনে,
সে যে ঘুমের ঘোরেই আসে মনে--
ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ
কর গো দেশছাড়া।
আমি আপন মনের মারেই মরি,
শেষে দশ জনারে দোষী করি--
আমি চোখ বুজে পথ পাই নে ব'লে
কেঁদে ভাসাই পাড়া ॥