Skip to main content

কে কখন কোথায় কিভাবে আত্মহত্যা করবে তার কোনো অ্যাপ্স বানানো যায়? মানে ধরুন কোউইনের মত। না, বানানো যায় না। তবে তো তার ব্যক্তিগত জীবনের গতিবিধির উপর চোখ রাখা হবে। সে কি সার্চ করছে, কি চ্যাট করছে, কি আঁকিবুঁকি কাটছে - এ সব তো ভীষণ ব্যক্তিগত, তাই না?

এই যে আজ আলুচাষীর আত্মহত্যার খবর আছে, এই যে এক বাচ্চা মেয়ের শ্লীলতাহানির পর আত্মহত্যার খবর আছে। এই যে লিখছে কাগজে, ভারতেই নাকি সারা বিশ্বের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানের মোট ২০%, তবে?

পরীক্ষা ফেল, ব্যর্থ সম্পর্ক, ঋণ, রোগ, প্রিয় মানুষের মৃত্যু, আরো অনেক কারণ থাকে যা জানা যায় না, কিন্তু অবশেষে মানুষটা নিজে থেকে চলে যেতে চায়।

আমি প্রথম কবে আত্মহত্যার কথা শুনেছিলাম মনে নেই। কিন্তু জানি আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করতে মানুষ ভয় পায়। নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে সংশয় হয়। যেন কোথাও সব আত্মহত্যায় আমাদের সম্মতি থাকে, আমরা যেন বুঝি কেন সে চলে গেল। যেন মনে মনে বলি, ঠিকই করেছে, কি হবে বেঁচে। তাই হয় তো আমরা যারা মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ না, যারা মানুষের মনের শুশ্রূষা করাকে পেশা হিসাবে নিইনি, তারা মাঝে মাঝেই নিজের দুর্বলতার কাছে হেরে গিয়ে বলি, বেশ করেছে! মনে মনে বলি। মুখে বলি অন্য কথা। সে তো আমাদের কবেকার অভ্যাস। মনের কথা মুখে না আনার অভ্যাস। বরং বিপরীত কথা বলার অভ্যাস। আমাদের প্রকাশিত 'নকল মন' আর গুপ্ত 'আসল মন' এর মধ্যে কোনো সেতু থাকে না।

সে যত ভাগেই আমরা নিজেদের ভাগ করে রাখি না কেন, বাঁচতে যে একটা বিশ্বাস লাগে, এ কথা অস্বীকার করতে পারি না। বিশ্বাস একটা সদর্থক আবেগ। সেই আবেগে অনেক অন্ধকারকে অস্বীকার করা যায়। সেই আবেগে অনেক কঠিন বাধাকে অতিক্রম করা যায়। সম্পূর্ণ হতাশজনক অবস্থাতেও আশা রাখা যায়। মূলে এক আবেগ। বিশ্বাসের আবেগ।

যে মানুষটা শেষ ধাপটা বেছে নিচ্ছে, সেও এক বিশ্বাসেই বেছে নিচ্ছে, এই একমাত্র রাস্তা। হতাশার মধ্যেও এক বিশ্বাস আছে। শূন্যের উপর বিশ্বাস। অন্ধকার গহ্বরের উপর বিশ্বাস। নিজের অনস্তিত্বের উপর বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া মানুষ একটা শ্বাসও নিতে পারে না। কোনো কিছুকে বিশ্বাস করি না - এ কথাটা বলা মানুষটাও এক বিশ্বাসেই এ কথা বলে।     

তবে শূন্য হয় কেন সব? বিশ্বাস তো হারায় না দেখলামই। বিশ্বাসের সঙ্গে আরেকটা আবেগ আছে। আস্থা। আস্থা আর বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য হল, যে মানুষটা বিশ্বাস করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে, সে আদতে বিশ্বাস হারায়নি, হারিয়েছে আস্থা। আস্থা আর বিশ্বাস দুটো শব্দ বড় কাছাকাছি। পার্থক্যটা কি তবে? আস্থা হল ভালোবাসামাখা বিশ্বাস। বিশ্বাস সব সময়েই সদর্থক আবেগ। সে সদর্থ আবেগ মৃত্যুকেও সদর্থ ভাবাতে পারে। কিন্তু আস্থা পারে না। আস্থা মাধুর্য মাখা সদর্থ আবেগ। সে মৃত্যুকে বরণ করলেও সে হয় "মরণেরে করে চির জীবন নির্ভর", এই দর্শনে। সে প্রেমের মধ্যে লীন হতে চাওয়া, অনস্তিত্বের অন্ধকারে শূন্য হওয়া নয়।

ভারতীয় দর্শনে মায়া আর লীলা এই দুটো শব্দ আছে। একে অপরের পরিপূরক। সব যে ক্ষণস্থায়ী, এক অপ্রকাশিত সত্যের ছায়ামাত্র, এ মায়ার দর্শন। সেই ক্ষণস্থায়ী ছায়ার উপর যে মাধুর্যের রামধনু, সে লীলার দর্শন। দুইকে নিয়েই সত্য। বিশ্বাস মায়ার দিকে। আস্থা লীলার দিকে। মানুষের হাঁটতে লাগে বিশ্বাস, হাত ধরতে লাগে আস্থা। তাকাতে লাগে বিশ্বাস, দেখতে লাগে আস্থা।

মানুষ আস্থা হারালে ভ্রান্ত। ভ্রান্ত মন, ভ্রান্ত মতি, ভ্রান্ত বিচার, ভ্রান্ত ভাবনা, ভ্রান্ত দিগবিদিক। অনেকেই পারে দাঁতে দাঁত চিপে টিকে থাকতে। ধৈর্য ধরতে। চিত্তের স্থৈর্য না হারাবার ক্ষমতা অনেকের থাকে। কিন্তু কেউ কেউ পারে না। সে যে আর কোনোদিন আস্থা ফিরে পেতে পারে, এ ভাবনাই হারিয়ে যায় তখন।

মানুষের জীবনের ভিত্তিস্বরূপ আস্থা হল নিজের উপর আস্থা। নিজের উপর মাধুরী মাখানো ভালোবাসা। সে তার জন্মপ্রাপ্ত ধন। তার নিজের উপর নিজের মান। যাকেই বললাম আস্থা। আস্থার কার্যকরী দিক ভরসা। ভরসা জীবনকে গতিময় করে। গতি ফিরে এলে সব ফিরে আসে।

এই আস্থা কি অন্যের জীবনে চারিয়ে দেওয়া যায়? যায়। বৈষ্ণব শাস্ত্রে একটা কথা আছে, সাধুসঙ্গ। সঙ্গগুণ। সাধু - যার সঠিক অর্থ হল, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন না, যিনি আস্থা রাখেন। যিনি আগামীদিনে ঈশ্বর তাকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন এ বিশ্বাসে বাঁচেন না, যিনি প্রতি মুহূর্তকে আস্থার উপর রেখে নিজের জীবনের গতি নির্ধারণ করেন। তাই আস্থা মানুষকে সাধক বানায়, অন্বেষক বানায়। বিশ্বাস শুধুই অন্ধ বানায়, গোঁড়া বানায়।

বৈষ্ণব সাধক বলছেন, এ আস্থা তোমার মধ্যেও চারিত হবে। আমাদের বৈষ্ণব শাস্ত্র নিতে হবে না, এ তত্ত্বটুকুকে নিয়ে ভাবলেই হবে। অর্থাৎ একটা জীবনের আস্থা আরেক জীবনে চারিত হয়।

একবার ভারতের হ্যাপিনেস ইণ্ডেক্সে দেখা গিয়েছিল ভারতীয়দের মধ্যে সব চাইতে যেটার বেশি অভাব সেটা হল পারস্পরিক আস্থাবোধ। এ খুব বড় বিপদের কথা। মানুষ টাকাপয়সা, সুখে, সমৃদ্ধিতে বাঁচে না শুধু। মানুষ দারিদ্র, যুদ্ধ, ঝড়বন্যা, মহামারী সব কিছুর সঙ্গে লড়ে যায়, শুধু যদি তার চিত্তে অমৃতস্বরূপ এই আস্থাটা থাকে। তার অভাবে মানুষ বাঁচে কি করে?

'আগন্তুক' সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্র 'অন্ধজনে দেহ আলো' গানের পর বলছেন, কে দেবে আলো?

মানুষই দেবে আলো, যদি মানুষই আলো নিভিয়ে থাকে। সেল্ফ-পিটি বা আত্ম-দরদের বিষময় সাগরকে অহংকারের দাঁড়া দিয়ে মন্থন করে করে শিল্প-সাহিত্যের আঙিনা ভরালে পরবর্তী প্রজন্ম একদিন দুর্গন্ধে এ রাস্তা মাড়াবে না আর। একটা কবিতা মনে পড়ল,

 

Self Pity/ D H Lawrence

I never saw a wild thing

sorry for itself.

A small bird will drop frozen dead from a bough

without ever having felt sorry for itself.

 

আস্থাকে খুঁজতে হবে কি? একদম না। প্রত্যেকটা মানুষের ভিতরে আজীবন একটা শৈশব থেকে যায়। যে কুঁড়ি বাইরের আলো, বাতাসে চোখ মেলে সে শুধু বাইরের আলো বাতাসের ভরসাতেই চোখ মেলে না, তার ভরসার মূল জায়গা তার সবুজ বৃন্তটা। আমাদের বৃন্ত সেই আমাদের শৈশবের সারল্যমাখা মনটা। সে মরে যায় না, সে চাপা পড়ে থাকে। তাকে জাগালেই আস্থা আবার গুটি গুটি পায়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। জগত জোড়া আবার খেলার মাঠ হয়। খেলা মানে তাচ্ছিল্য নয়, খেলা মানে হারজিৎ যাই হোক না কেন, আবার মাঠে ফেরার তাগিদ। সে তাগিদই আস্থা। নিজের মধ্যে সে আস্থাকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, অন্যের মধ্যে চারিয়ে যাবে তবে অজান্তেই। একটা জীবনকে আগলানোও আরেকটা জীবন দান করা। আরো প্রাণ আসুক, আরো প্রেম, আরো নামুক আমি। শান্তি আসুক জীবনে।