বলা হল যদি তুমি তারাখসা দেখতে দেখতে কিছু চাও, তুমি পাবে। আবার কেউ বলল, চোখের ঝরাপাতা হাতে যা চাইবে, পাবে।
এগুলো কি সত্যি? সত্যিই। কারণ কোনো এক তাৎক্ষণিক ক্ষণিকের মুহুর্তে যে চাওয়াটা মনে পড়ে, সেই চাওয়াটাই তো আমার গভীরতম চাওয়া। সবারই কি থাকে? এর উত্তর 'হ্যাঁ'-ও আবার 'না'-ও। কিছু চাওয়া তো সবারই থাকে। তবে ঐকান্তিক চাওয়াটা কি সবার থাকে? থাকে। তবে দশের ইচ্ছায় সেটা এত তলিয়ে যায় যে তার টিকিটাও আর দেখা ভার। এই দশের ইচ্ছা বনাম আপন ইচ্ছার লড়াইয়ে, আপন ইচ্ছাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে তবে কোনো কথা। না তো সেই বিখ্যাত লাইন রবীন্দ্রনাথের - নূপুরের মত বেজেছি চরণে চরণে.... সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে...
সেই ঐকান্তিক চাওয়ার একটি গভীরতম আদি চাওয়া, নিজেকে চাওয়া। নিজেকে বুঝতে চাওয়া। নিজেকে জানতে চাওয়া। সারাদিনের ঘাত-প্রতিঘাত, হাসি-কান্না, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে তো নিজেকে জানছিই। তবে কোন অতল থেকে একটা গভীর বেদনা জেগে উঠে উদাস করে - এ নহে, এ নহে। মানুষ আত্মমগ্ন হয়। তবে কে সে?
মানুষ বুঝতে পারে, সে নিজের মধ্যে যেন কোথাও পুরোপুরি এক না। তার মধ্যে নানান বৈপরীত্য। নানান অনুভূতি, নানান উপলব্ধি। কোথাও যেন তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। সে তখন এই চিত্তস্রোতের ভাবের প্রবাহতে ভাসতে ভাসতেই তল খুঁজতে শুরু করে। দেয় চিত্তস্রোতে ধ্যানের পাড়ি।
নিজেকে লাগতে লাগল অজানা। এ কে? এ কে বাসা করে আমারই চিত্তগুহায়? কার মন্দ্রিত কণ্ঠস্বরে আমোদিত আমার চিত্ত। কে সে? কে?
এমনভাবে সে হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সমাজের মূলস্রোত থেকে কিছুকাল। তার মাথায় জন্মালো জটা, সারাগায়ে হল মাটির ঢিবি। সংসার টের পেল না বাইরে থেকে কিছু। সবাই ভাবল, সে বুঝি হল পাগল। কিম্বা উদাসী। বয়স্কেরা বললে, না না, এ যে সন্ন্যাসী। নিন্দুক বলল, কঠোর বাস্তব থেকে পলায়নের মতলব, হুঁ, বেশ বুঝেছি।
সে থাকল স্থির। অবিচল। তার মনে লেগেছে কোন অজানা সমুদ্রের ঢেউ। সে তলিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান থেকে জ্ঞানান্তরে। এক উপলব্ধি থেকে আরেক উপলব্ধিতে। মন কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে। তার সাথে আসছে সারাটা বিশ্ব। সবাইকে সে নিজের মধ্যে অনুভব করছে। কেউ তো পর নয়। আবার কেউ আপনও তো নয়। প্রবহমান কালের স্রোত বয়ে চলেছে। সেই স্রোতে কেউ কাছে আসছে কেউ দূরে যাচ্ছে। সেই কালস্রোতে বুদবুদের মত অজস্র প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে। কাল বয়ে যাচ্ছে সব কিছুকে ক্ষয় করে, আপন গর্ভ থেকে জন্ম দিয়ে আপন গর্ভেই লয় করে।
এসবের সাক্ষী যে চেতনা, সে নির্লিপ্ত, সে প্রসন্ন, সে করুণাময়। একা বসে নির্বিকার সব ঘটনার সাক্ষী। না আছে তার কান্না, না আছে তার হাসি। সে থামাচ্ছে না কিছুই, আবার ঘটাচ্ছেও না কিছুই। তাকেই চিনতে পারার কথা ছিল যেন এ সংসার সংসার খেলা শেষ হলে।
কিসের সে করুণা? সে করুণা চিত্তপ্রসাদের। জ্ঞানের আত্মময়তার। সার্বিক আত্মীয়তায় যার পরিণাম। তখন সে বোঝে যা ছিল তা পূর্ণ, যা আছে তা পূর্ণ, যা থাকবে তা পূর্ণ। এই পূর্ণের স্বাদ, এই পূর্ণের প্রেম, এই পূর্ণের আশ্রয় তাকে আবার সবার কাছে ফিরিয়ে আনে। চেনা সংসারে অচেনা হয়ে, নিষ্ঠুর এ সংসারে চির আপন হয়ে।