Skip to main content
 
 
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শালা এবারের দোসরা অক্টোবরটা রবিবার পড়ে গেল। পুরো ছুটিটার পেছন মারা গেল।“ 
যিনি বললেন তিনি এইট পাশ বা মাধ্যমিক পাশ বা সাধারণভাবে স্নাতক নন। আরো দীর্ঘ তার শিক্ষা আমদানির তালিকা। 
এটা অবশ্য নতুন কথা কিছু না। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। তাছাড়া যার জন্য ছুটিটা, তিনিই বা কি এমন মানুষ? একজন অত্যন্ত কূট, পরশ্রীকাতর, দেশভঙ্গকারী, ঈর্ষাপরায়ণ, কামুক, স্বেচ্ছাচারী, গোঁয়ার, সুবিধাবাদী বিখ্যাত মানুষ। এর প্রতিটা বিশেষণের সাথে বহু ইতিহাসপ্রাপ্ত নিদর্শন তালিকা একটু পড়াশোনা জানা বাঙালীমাত্রই বলতে পারবেন (ব্যতিক্রমও আছেন অবশ্য, আমার মত ইতিহাসে কাঁচা)। টাকার নোটে কেন ওনার ছবি। নেতাজী বা ভগৎ সিং যাদের দেশপ্রেমের ক্যারিয়ারে উনি জল ঢেলেছিলেন তাদের ছবি থাকবে না কেন? আমাদের পাড়াতেই তো, ২৩শে জানুয়ারী পতাকা উত্তোলন হয়, আজকে হয় না। না হওয়ার জন্য উপরের কারণগুলোর থেকে আর বেশি কারণ নিশ্চই চাই না?
আমি না সে আলোচনায় যেতে চাই না। এইসব উৎকৃষ্টমানের আলোচনা শুনতে শুনতে বয়েসটা গড়িয়ে অনেক হল। আর এসবে যেতে চাইছি না। তাই যদি সেরকম কোনো অভিসন্ধি নিয়ে পড়েন বা কমেন্টস করেন, আমার অনুরোধ প্লিজ করবেন না। কারণ সোজা কথা – আমি মানুষটার কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। তাঁর অসামান্য আত্মজীবনীর জন্য বিশেষ করে। 
বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর সুদীর্ঘ আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলছেন, আচ্ছা যদি গান্ধীকে নাৎজি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হত, তবে কি অহিংসা কাজে আসত? বলেই বলছেন, তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি অহিংসার পথকে অমান্য করছি। আমি সে পথকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রাসেল জীবনের প্রান্তবেলায় কারাবরণ পর্যন্ত করেছিলেন কিছুটা যুদ্ধ বিরোধী কথা বলার জন্যেই, তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।)। এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। তবে বুদ্ধ, খ্রীষ্ট থেকে শুরু করে মহাপ্রভু অবধি এই পথের পথিক, কমজন না। সে সব জীবনেও আততায়ীর ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। তবে মশালটা নেভেনি। কারণ তাঁরা কেউই একটা মানুষ নন, একটা চরিত্র, একটা ঘটনা, একটা দৃষ্টান্ত। 
আসলে কোনো পন্থাকেই চূড়ান্ত পন্থা বলে ভাবার মধ্যেই ভুলটা হয়। আমি একটা পথে চলছি মানেই যে বাকি পথের বিরোধিতার কথা ভাবছি, তা কেন হবে? আজকের পরিস্থিতিতে দেখা যাক। আজ ভারত এক সংকটাপন্ন মুহুর্তে দাঁড়িয়ে। এখানে কি অহিংসা পথ চলবে? না। চলবে না। তবে কি মহাত্মা ভুল প্রমাণিত হলেন? কখনোই না। অহিংসার মূল কথাটা কাপুরুষতা না। তার মূল কথা হল – সত্যাগ্রহ। 
এই সত্যাগ্রহ শব্দটার মধ্যে আক্ষরিক অর্থে না ঢুকে আরেকটু গভীরে গিয়ে তাকালে একটা বোধের আভাস পাওয়া যায়। সত্য'র শক্তিতে দাঁড়ানো। সত্যকে একমাত্র যুক্তি, আশ্রয়, উদ্দেশ্য আর উপায় ভাবা। অনবরত সত্য'র অনুসন্ধানে রত থাকা আর যেটুকু আলো পাওয়া যায় তাতেই নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্য প্রস্তত থাকা।
তবে এখানে হিংসার কথা বা অহিংসার কথা কেমনভাবে আসে? আসে। হিংসায় সত্যকে দেখা যায় না। অহিংসায় দেখা যায়। অহিংসা মানে প্রেম বললে অনেক বড় শব্দ শোনায়। এতটা বলা যায় হিংসা না থাকা। প্রেম নাই বা থাকল। উরিতে যা ঘটানো হল – তা হিংসা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাইরের শত্রু আর লাগবে কেন? দেশের গভীরেও কত... এক ট্রেন নিরীহ মানুষকে ফিশপ্লেট খুলে দিতে তো কোনো পাক জঙ্গীসংগঠন আসেনি! সে কথা থাক। তবে ওটাই হিংসা। আর আমাদের এখন যা করা হচ্ছে, তা প্রতিক্রিয়া। আত্মরক্ষার্থে। তা কখনোই হিংসার পথ না। বাইরের আচরণই যদি আদর্শের পরিমাপ হবে, তবে আত্মঘাতী জঙ্গিরা মহাপুরুষের পর্যায়ে চলে যায়। ভুল হোক চাই ঠিক হোক, তারা একটা আদর্শের জন্যেই তো প্রাণ দিল! কিন্তু তারা তো আর সামাজিক জীব নয়। তাদের আদর্শ সত্যনির্ভর না। স্বার্থনির্ভর, হিংসানির্ভর। যদিও স্বার্থ আর হিংসা সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় একটু দূর এগোলেই। যে পথে দায়িত্ব নেওয়ার তাগিদ নেই, অধিকার আর দাবীর তাগিদে সব করা যায়... যে পথে কর্তব্যের কোনো দায়ভার নেই... সে পথে শুধুই উন্মাদনা। সবচেয়ে বড়ো কথা, সে পথ অমানবিক। এ কথাগুলো হয় তো বাহুল্যই হল। কিন্তু দেশে তাদের সমর্থন করার মতও এত ছদ্ম-উদারতার হিড়িক পড়েছিল ক'মাস আগে। তাই স্পষ্টভাবে বলে দেওয়াই সমীচীন মনে হল। 
তা হলে সত্যটা কি? সেটাই সত্য যার উপরে পারস্পরিক সহাবস্থানের কথা ভাবা যায়। সে আমার পরিবারের বেলায় সত্য, পাড়ার বেলায় সত্য, দুটো দেশের মধ্যেও সত্য। মনে পড়ে সেই বিখ্যাত গান... “তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল... রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল...”
আর একথাটা আমরা বুঝি বলেই বর্তমান পরিস্থিতে সে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি না। আপ্রাণ চেষ্টা করছি যুদ্ধটার কোনো বিকল্প পথ খুঁজতে। কারণ আবেগে ভেসে, উত্তেজনায় একটা সিদ্ধান্তে লোকের চোখ ধাঁধানো যায় বটে, কিন্তু সে সিদ্ধান্তের দায়ভার বহন করার বেলায় ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ এসে পড়ে। অথবা নীরবে সরে দাঁড়াতে হয়, উদাহরণ – বুশ।
এ তো গেল সমষ্টিগত জীবনের বিশাল ক্ষেত্রের কথা। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এই সত্যাগ্রহের মূল্য কি? সে মূল্যও অপরিসীম। তার আগে বুঝতে হবে, সত্যের প্রধান শত্রু কে? সত্যের প্রধান শত্রু মিথ্যা না। প্রধান শত্রু হল অলসতা। আমি জানি সত্যিটা কি। তবু মানব না, কারণ আমার অলসতাকে আমি 'ডিফেণ্ড' করতে চাই। নানান যুক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চাই... ”জাগায়ো না আমায় জাগায়ো না”... জাগলেই যে কাজে নামতে হবে। আর কাজ মানেই তো ঠিক বেঠিকের হিসাব করে সামনের দিকে এগোনো। কি দরকার, সবাই যা করছে, বলছে, ভাবছে তাতেই গা ভাসিয়ে দাও না। ঠিক হলে আমার লাভ, ভুল হলে সার্বজনীন দায়। কি মজা। ঘুম চলুক। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তর্ক বিতর্ক চলুক। ঘাম না ঝরুক, মাথা না ঘামুক। শুধু মুখ চলুক। মহাত্মার জীবনী লিখতে গিয়ে লুইশ ফিসার তার কালজয়ী বইতে বলছেন না, মহাত্মা কোনো বিশাল কাজ বা বড়ো কাজ করেননি, তিনি সেই সব কাজই করেছেন, যা চাইলে আমরাও করতে পারতাম, কিন্তু করিনি।
 
মহাত্মা এই সত্যের জায়গায় একটু সচেতন করে দিতে চাইছেন। সত্য'র উপর নিজের যা কিছু সব সমর্পিত রাখতে বলছেন। নিজের জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় এমন একটা ব্যাঙ্কে রাখলাম, দিনের শেষে সে ব্যাঙ্ক ডুবে গেল, আমি দেউলিয়া হলুম। কারণ ব্যাঙ্কটা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মিথ্যার অঙ্কের মহিমায় আমায় ডুবিয়ে দিল। যে পরিমাণ লাভ সাধারণ ব্যাঙ্ক দিতে পারছিল না, সে ব্যাঙ্ক দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। সত্য বলল, এ হয় না। শর্টকাট মানেই কোথাও একটা গোল আছে। লোভ বলল, তত্ত্বকথা রাখো। শেষে ভরাডুবি হল। 
এই উদাহরণ রূপক জীবনাদর্শ হিসাবে যেমন সত্য, সারদা কাণ্ড হিসাবেও ততটাই সত্য। খুব কঠিন না এই অলসতা ত্যাগ করা; যেমন যতক্ষণ না বিষধর সাপ রাস্তায় দেখছি, ততক্ষণ লাফিয়ে পালানোর মর্ম বুঝেছি কি? না বুঝিনি। ততদিন পালানো উচিৎ, কি উচিৎ না এই তর্কে মজে আছি। ম্যাক্স মুলার বলতেন, সত্য যদ্দিন না অনুভূত হয়, তদ্দিন আউড়েই যায় মানুষ। তাতে কি আর পেট ভরে দাদা? 
আমরা যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছি, সাধের সংসার পেতে দিবানিদ্রা দিচ্ছি, আর মাঝে মাঝে একটা আধটা ফুলকি দেখে ভাবছি, এ আর এমনকি... একটা বড় গামলা এনে সব লাভা সরিয়ে রেখেই আবার ঘুম দেব... সেই অজ্ঞতার উদ্দেশ্যে মার্টিন লুথার কিং -এর কথাটা বলে ইতি টানি...
"We may ignore him at our own risk."