“তুমি ঠিক করে দেওয়ার কে?”
এই প্রশ্নটা আমার কাছে খুব বিভ্রান্তিকর লাগে।
একটা বাড়িতে একটা নির্দিষ্ট প্রথা থাকে। নৈশভোজের সময়, পোশাকের মান, উৎসবের প্রকার ইত্যাদির। আমার বাড়িতে ১০টায় খায় রাতে, তোমার বাড়িতে ১১টায়। আমার বাড়ির মেয়েরা সালোয়ার পরে, তোমার বাড়ির মেয়েরা শাড়ী। আমার বাড়িতে লক্ষীপূজোর চল আছে, তোমার বাড়িতে সরস্বতী।
এরকম পাড়া, রাজ্য, দেশ অনুযায়ী এক একটা প্রথা, রীতি, কৃষ্টি, সংস্কার ইত্যাদি চলে আসছে। তা পরিবর্তন হয়েছে, পরিমার্জন হয়েছে। পুরোনো নিয়মের জায়গায় নতুন নিয়ম এসেছে। এভাবেই এগিয়েছে। একদিকে সে বেঁধেছে, আরেকদিকে সে খুলেছে। এই বাঁধন আর খুলনের সামঞ্জস্যতাতেই একটা পরিবার তথা সমাজ এগিয়ে চলেছে। হাঁটতে গেলে যেমন একটা পা মাটিতে স্থির রেখেই আরেকটা পা তুলতে হয়, সিঁড়িতে উঠতে গেলে যেমন একটা পা এক সিঁড়িতে রেখেই আরেকটা পা অপর সিঁড়ির দিকে এগোতে হয়, তেমনই একটা নিয়মে স্থির থেকেই ততক্ষণ অপর নীতিতে যাওয়া যায় না, যতক্ষণ না তা পূর্ব নীতি অপেক্ষা উন্নত বলে বিবেচনার দ্বারা স্থির হয়।
প্রশ্ন হল এই বিবেচনা করবে কে? এখানে দুটো উত্তর আসে। এক, জনতা। দুই, সুবিবেচকেরা। গণতন্ত্রের মধ্যে যে ‘তন্ত্র’ শব্দটা আছে, তার একটা অর্থ শৃঙ্খলা, অথবা একটি সিদ্ধান্তনির্ভর পথ। একটা প্রতিষ্ঠিত বিধি বা নিয়ম, যা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা সৃষ্ট। কিসের জন্য সৃষ্ট? শাসনের জন্য। প্রশ্ন আসে সঠিক নেতৃত্বের।
প্লেটোর কথা অনুযায়ী – প্রজ্ঞা, সংযম, ন্যায়বোধ ও সাহস এই চারটির প্রকাশ যে ব্যক্তিত্বে সে-ই সঠিক নেতৃত্বের অধিকারী। জনগণ একটা শক্তি। কিন্তু তা অসীমের দৃষ্টিতে গতিময় হলেও ক্ষুদ্রকালের গণ্ডিতে তা দিশাহীন। মানুষকে সঠিক জ্ঞান কখনও জনসাধারণে দেয়নি, দিয়েছে আলোকপ্রাপ্ত অসাধারণেরাই। না হলে আজও পৃথিবী স্থির থাকত আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে হত। আপনার আমার চারপাশে যা কিছু বুদ্ধিগত তত্ত্ব ও প্রযুক্তিগত বস্তু ব্যবহার করছি – সবই কোনো ব্যক্তির অবদান, আমজনতার নয়। একটা সেফটি পিন থেকে শুরু করে একটা অত্যাধুনিক মহাকাশযান অবধি কোনো ব্যক্তিগত মস্তিস্কপ্রসূত। যার প্রণালীবদ্ধ ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ ব্যবস্থাকে আমরা সিলেবাস বলি। আমাদের বিদ্যালয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় মানুষের বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের অগ্রগতির মাইলস্টোনগুলোর সাথে, যার প্রতিটি উদ্ভাবনের সাথে একটি করে ব্যক্তির নাম জড়িয়ে, যাঁরা সামান্য না, অসামান্য ছিলেন।
এইবার প্রশ্ন আসে ন্যায়ের ক্ষেত্রে কি নানা মুনি নানা মত হয় না? হয়। আর সেখানেই আসে জনতার ভূমিকা। সে কার কথা শুনবে। রামায়ণে আমরা দু’জন পরামর্শকের ভূমিকা দেখেছি। এক বিভীষণ, দুই মন্থরা। তা শোনা না শোনার পরিণামও সবার জানা। পুরাণে শুক্রাচার্য ও বৃহষ্পতি দুই গুরুর কথাই উল্লেখ আছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে কিছু একটাকে স্থির করে নিয়েই সব চলে। আপনার স্কুলের একটি ছাত্র বা ছাত্রী শুধুমাত্র যদি অন্তর্বাস পরিধান করে বিদ্যালয়ে আসে, আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা হয়ে? সে যদি বলে এ আমার নিজস্ব পোশাকের মত? আপনি বলবেন এ শালীন নয়। সে বলবে এই শালীনতা নির্ধারণ করবার আপনি কে? একজন বলল, আমি এই সিলেবাসে পড়ব না। আপনি কে সিলেবাস ঠিক করে দেওয়ার? আমি মার্চ মাসে পরীক্ষায় বসব না। আপনি কে পরীক্ষার রুটিন ঠিক করার? এ তর্কের অবসান নেই। কারণ এর একটা যুক্তি অন্য যুক্তিতে এসে কাটে। ফলে চলতেই থাকে চলতেই থাকে। থামব কোথায়? সংযমে। সংযম কিসে? আমার আপনার যাতে মঙ্গল তাতে। কিসে মঙ্গল? সেটা শুধু যুক্তি স্থির করতে পারে না। পারে সহানুভূতিসম্পন্ন অন্তর্দৃষ্টি বা প্রজ্ঞা। ফের সেই নেতৃত্বের প্রশ্ন। সাময়িক ক্ষিপ্র উন্মাদনার না। বিপ্লব মানে উন্মাদনার থেকে বেশি কিছু, তা গলার জোরে হয় না। ক্ষেপিয়ে দিয়ে হয় না। সে আপন দাবীর সত্যের জোরে জায়গা নিয়েই ছাড়ে, আজ না হয় কাল। তাকে কোনো প্রশাসন চিরটাকাল দাবিয়ে রাখতে পারে না। আর সত্যের পথিক কখনও আত্মহননের পথ বাছে না, প্রত্যাঘাত বা অসহযোগের পথ বাছে। দুয়ের পিছনেই থাকে তার উপলব্ধ সত্যের জোর। যে শক্তি অমর।
সেই সত্যকে উপলব্ধি করার স্থৈর্য্য, ধৈর্য্য আমাদের আসুক। উত্তেজনা না, উদ্দীপনা আসুক। প্রচারের, রাশি রাশি সমর্থনের ধাঁদালো আলোয় না, সত্য ও মঙ্গলের স্থির আলোয় গতিপথ নির্ধারিত হোক।
তাই উপনিষদের সেই প্রাচীন বাণীতেই ইতি টানি – “সত্যমেব জয়তে নানৃতং”। সত্যেরই জয় চিরটাকাল হয়ে থাকে, মিথ্যার না।