মানুষের তো শুধু মহিমাই নেই, মানুষের তো সঙ্কীর্ণতা, অসহায়তাও রয়েছে। সে সঙ্কীর্ণতাকে আমি যে নামেই ডাকি না কেন – স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ক্ষুদ্রবুদ্ধি – ইত্যাদি যাই বলি না কেন, আছে তো। এত যে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, খুনোখুনি, অত্যাচার, ধর্ষণ – এ সবই মানুষেরই কাজ। এ তো মহত্ব নয়। যে মানুষটা ঠাণ্ডা মাথায় কারোর ক্ষতির জন্য, নিজের লালসা তৃপ্ত করার জন্য চক্রান্ত করছে, ষড়যন্ত্র করছে – সেকি নিজের মনুষ্যত্বের মহত্বের কথা মনে রাখছে? রাখে না। আমি বড় বড় উগ্রপন্থী চক্রান্তের কথা বলছি না, আমি বলছি আমাদের নিত্য জীবনে ছোটো ছোটো বিষয়ে অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়া, মাড়িয়ে যাওয়ার চক্রান্তের, ষড়যন্ত্রের কথা। সেকি কম! সে কথা কাগজে ছাপা হয় না, টিভিতে দেখানো হয় না সত্যি, কিন্তু প্রতিদিন সংসারটাকে পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে রাখে, এ তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই পাঁক তৈরিতে কি আমারও অবদান নেই? আমি কি কেবলই অন্যের তৈরি ফাঁসে জড়িয়ে, তা কেটে বেরোনোর লড়াই করি? আমি কি নিজের হাতে, নিপুণ কৌশলে অন্যের জন্য ফাঁদ পাতি না, সে ফাঁদে কি নিজেই পড়ি না? সে ফাঁসে কি নিজেই জড়াই না?
একদিন যাকে খুব ভালোবাসতাম, তার সমস্ত দোষগুণ স্বীকার করে নিয়ে, কিছুটা প্রশ্রয়ে, কিছুটা মানিয়ে নিয়ে তাকে নিয়ে বেশ চলছিলাম। কারণ সেদিন সে ছিল গুরুত্বপূর্ণ আমার আবেগে অনুভবে। হঠাৎ আমার মনের কি যে হল, তাকে আমার আর মনে ধরল না। হঠাৎ করে মনে হতে শুরু করল সে যেন একটা মূর্তিমান আপদ আমার জীবনে। তার যে স্বভাব-অভ্যাসকে একদিন না শুধরিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি, আমার ভালোবাসাকে কায়েমি রাখব বলে, কারণ আমি জানি তার দুর্বল জায়গাগুলোকে যদি আমি মেনে নিই, তবে সে আমারই রইল। কিন্তু আজ আর তা যে পোষাচ্ছে না! আজ আমার তাকে না হলেও চলে। তাই আজ প্রতি মুহূর্তে তাকে অপদস্থ করে, ছোটো করে, অপমান করে, দিশাহীন করে – কি এক অবিবেকি মুক্তির আনন্দ পাচ্ছি। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে বোঝাচ্ছি যে, যা ঠিক বলে মনে হচ্ছে আমি তো তাই করছি, সেদিন অনেক অসুবিধা ছিল তাই বলিনি, আজ বলছি, কারণ আজ আমি অনেক বেশি স্বাবলম্বী। কি করে এত স্বাবলম্বী হলাম? আজ যে আমার হৃদয়ে তার জন্যে কোনো বিশেষ জায়গা নেই, তাই হঠাৎ করে সব কিছু সহজ আমার জন্য। এ-ও নীতি, এ-ও এক পথ, তবে সঙ্কীর্ণ পথ। মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস, রুচি নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। সে যুক্তির রাজ্য নয়, সে অনুভবের রাজ্য। সেখানে দুটো শব্দই যায় – এক উদার, দুই সঙ্কীর্ণ। হয় আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা, রুচি উদার, নয় সঙ্কীর্ণ। তাকে অকারণে যুক্তির শিখরে চড়িয়ে তার মহিমা বাড়ানো যায় না। অতি নিম্ন স্বার্থকেন্দ্রিক রুচির জন্যেও বড় বড় যুক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। অবশেষে তা মূল্যহীন।
আবার আরেক দিকও তো আছে। আমার ভালোবাসাকে নিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া। আমি যাকে ভালোবাসি সেও যে আমায় একই মাত্রায় ভালোবাসবে এ তো হয় না। আর হয় না বলেই যত গোল। ভালোবাসা আর ভালোলাগার মধ্যে একটা শব্দের দূরত্ব আছে – নিজের করে চাওয়া। এমন তো অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে, যা আমি চাই না, কিন্তু ভালো লাগে। তেমন অনেক মানুষও আছে যাকে আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে আমার করে চাই না, কিন্তু তার সঙ্গ, তার আলাপ আলোচনা আমার ভালো লাগে। সেরকম আমাকেও অনেকের ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু আমাকে কি সে তার নিজের করে চায়? চায় না। অথচ আমি তাকে চাই। আর আমার অশান্তির সূত্রপাতও এখান থেকেই। আমি তাকে চাইলেও সে কেন আমায় চায় না? আমি যদি একটা বস্তু চাইতাম তবে সেই বস্তুর আমাকে চাওয়ার অপেক্ষায় না থাকলেও হত, কিন্তু আমি যাকে চাই সে তো মানুষ! অহংকারী মানুষ আমরা। নিজের চাওয়ার উন্মাদনায় অনেক সময়েই মানুষ আর বস্তুর মধ্যেকার ফারাকটা ভুলে যাই। তাই একজন মানুষ আমাকে না চাইলে, আমার চাওয়াটা যে অপূর্ণ থেকে যায়, সে আমায় পীড়া দেয়, যন্ত্রণা দেয়, আমি মেনে নিতে পারি না। আমি তখন নানা ভাবে তার মন পাওয়ার চেষ্টা করি। তার জীবনে নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার নানা সাধনে মাতি। কিন্তু তবু তার আমাকে চাওয়াটাকে যদি জন্মাতে না পারি? নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। তখন আমি বলপ্রয়োগ শুরু করি, তখন আমি নানা কৌশল চাতুরীর আশ্রয় নিই। নিজেকে লজ্জিত করি নিজের কাছেই। এইভাবেই একটা রেসিপ্রোকেশানের অভাব সমস্ত কিছুকে বিষিয়ে দিয়ে চলে যায়, যদি আমি আমার সীমারেখা না বুঝে থাকি তো। সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়, যেখানে চক্রান্ত শব্দটাই ছিল অবাঞ্ছিত। সে আরো বড় জ্বালা। জঞ্জাল আছে, অথচ ডাস্টবিন নেই। স্মৃতি কি ডাস্টবিন? না হৃদয় ডাস্টবিন? হৃদয় বিরহ বোঝে, কিন্তু ব্যর্থ চক্রান্তের মৃতদেহের ভার বইতে পারে না।
কিন্তু এর মধ্যেও চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র চলে সুক্ষ্মস্তরে। কেউ যখন বোঝে তাকে কেউ চাইছে, সে এক অস্বাস্থ্যকর খেলায় মাতে। সে অন্যের সেই চাওয়াকে কপটভাবে রেসিপ্রোকেট করে। যেন সে-ও তাকে চায়। অনেকের চাওয়াকে কপট রেসিপ্রোকেশানের অভিনয়ে নিজেকে বাস্তবের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, নিজেকে নিয়ে অসৎ খেলায় মাতে। যেন অনেকের তাকে চাওয়ায় তার নিজের বিশেষ কৃতিত্ব আছে, নইলে এত মানুষ তাকে চাইতো কেন? ক্রমে সে আরো চাতুরীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যত চতুর হয় তত একা হয়। কারণ অন্যকে প্রতারণা করে বেশিদিন রাখা যায় না, কিন্তু অন্যকে প্রতারণার খেলায় একবার নেমে পড়লে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো মানুষ হয়তো কয়েক বছর খুব বেশি হলে তার দ্বারা প্রতারিত হতে পারে, কিন্তু যে মানুষ নিজেকে ভোলাতে শুরু করেছে তার আর ঘোর কাটেই না। আজীবন সে নিজে যা নয়, নিজেকে তাই ভেবে জীবন কাটিয়ে দেয়। এ বড় দুর্ভাগ্যের। ওই যে বলছিলাম না, নিজের তৈরি ফাঁসে নিজেই জড়িয়ে পড়া, এ হল তারই উদাহরণ।
এরকম নানা চক্রান্ত রাতদিন ঘটে চলেছে চারপাশে। ভাইরাসের থেকেও সূক্ষ্ম। সে সব এড়িয়ে চলা কি চাট্টিখানি কথা? রামকৃষ্ণদেব বলতেন, কাজলের ঘরে থাকলে একটু কাজল লাগবেই। চারজন মানুষ একত্র হলেই এ সূক্ষ্ম চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের খেলা চলবেই, কারণ এ মনুষ্যস্বভাবোচিত। এর থেকে মুক্ত কেউ নয়। কেউ শিকার হবে, কেউ বা হবে শিকারী। কিন্তু ত্রাণ কারোর নেই। তা বলে মহত্ব নেই মানুষের স্বভাবে? আছে। সেও আছে। আমার বাড়ির ছাদ যেমন আছে, আকাশও আছে। খুব কম লোক সেদিকে তাকায়, এই যা।