You shall not covet your neighbor's house; you shall not covet your neighbor's wife, or his male servant, or his female servant, or his ox, or his donkey, or anything that is your neighbor's" (Exodus 20.17)
Enveloped by the Lord must be This All — each thing that moves on earth. With that renounce, enjoy yourself. Covet no wealth of any man.(Isha Upanishad, Hymn 1)
প্রথম উদ্ধৃতিটা বাইবেলের। দ্বিতীয়টা উদ্ধৃতিটা উপনিষদের। প্রথম উদ্ধৃতিটা বাইবেলের টেন কমেন্ডমেন্টেস এর শেষ কমেন্ডমেন্টস। আর দ্বিতীয়টা, ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকের। দুটো বাণীর মধ্যে একটাই সুর - মা গৃধঃ - লোভ কোরো না। অন্যের সম্পদে লোভ কোরো না।
লোভ কোরো না। কী সে লোভ কোরো না? অন্যের স্ত্রী, দাসদাসী, পশুপাখি কিছুতেই না। অন্যের কোনো সম্পদেই লোভ কোরো না।
কেন করব না? বাইবেল বলছে, কারণ এই ঈশ্বরের আদেশ। উপনিষদ বলছে, কারণ এ গোটা জগত ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত। লোভ আর ব্রহ্ম একসঙ্গে থাকে কী করে? ব্রহ্মকে জানতে গেলে লোভ ত্যাগ করতে হবে।
একজন শিরডিতে এসেছে সাঁইবাবার কাছে ব্রহ্মজ্ঞান নেবে বলে। সাঁই বললেন বোসো। এরপর সাঁই হঠাৎ আশেপাশের মানুষের কাছে টাকা চাইতে শুরু করলেন। তার নাকি ভীষণ দরকার। যারা প্রায়ই আসেন তারা একটু অবাক হলেন, কিন্তু সাঁই যে পরিমাণ টাকা চাইছেন তা তো তাদের কাছে নেই। সব গরীব মানুষ গ্রামের। কোথায় পাবে অত টাকা? এদিকে ব্রহ্মজ্ঞান নিতে আসা ভদ্রলোক অস্থির হয়ে পড়ছেন। বলছেন, ও মশায় একটু তাড়াতাড়ি করুন না, আমি ঘোড়াগাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছি যে, ব্রহ্মজ্ঞানটা নিয়েই টুক করে গাড়িতে উঠে বাড়ি যাই। অনেকটা রাস্তা।
সাঁই হাসলেন। বললেন, ভাই রে, এতক্ষণ ধরে যে পাঁচটা টাকা আমি চাইছি, তোমার কাছে তো তার থেকে বেশিই আছে, তা তো তুমি একবারও বলছ না যে এই নিন.... ভাই রে, যদি লোভ না ছাড়তে পারো তবে ব্রহ্মজ্ঞান হবে কী করে?
এই বলে সাঁই তাকে উপনিষদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন।
ব্রহ্মজ্ঞান একটা দূরের শব্দ। কঠিন শব্দ। কিন্তু 'গীতবিতান' কি দুই খণ্ডে 'শান্তিনিকেতন' বড় কথা হলেও, দূরের তো না। রবীন্দ্রনাথের দর্শনের মূল সুরই হল - 'লোভ কোরো না। সে পথে তোমার হয় তো অনেক বৈষয়িক লাভ হবে, তবু বলছি সে পথ তোমার না হোক।'
এ কথা বন্ধুর কথা। সুহৃদের কথা। মঙ্গলের কথা। শান্তির দিশা। সেই প্রাচীনকালে মনুষ্যপ্রকৃতির জটিলতা থেকে মুক্তির জন্য এ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল এ পৃথিবীর দুই ভূখণ্ডে, দুইকালে। যত দিন যাচ্ছে তার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে বই কমছে কই? লোভ কোরো না। অন্যের সুখ-সম্পদ-সমৃদ্ধি যেন তোমার দীর্ঘশ্বাসের কারণ না হয়। আমার অ-সুখের কারণ না হয়। তোমার মনস্তাপের কারণ না হয়। পরিশেষে নিজের মনকে যেন নিজেই বিষাক্ত করে না তুলি।
রবীন্দ্রনাথের বহু লেখায়, ভাষণে এ শ্লোকটার উদ্ধৃতি আছে। ধর্মের বাস্তব দিক এটাই। ধর্মের সু-রাহার দিক এটাই। রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবন এ শ্লোকের ধারাভাষ্য। হতে পারে আমি অতীন্দ্রিয় জীবনের কথা বুঝি না। হতে পারে আমার জীবনে মরমী অনুভব নেই। কিন্তু শান্তি চাই না, এ কথা বলি কী করে? আমার জীবনবোধ যদি আমায় শান্তি-আনন্দ-সংহতিমুখী না করে, তবে সে শিক্ষা কি আদৌ আমায় সার্থকতার দিকে নিয়ে যায়?
রবীন্দ্রনাথের গানে যে শান্তি পাই, সে এই শান্তিরসের বাণী। সারাদিনের শেষে শান্তি চাই, এ মিথ্যা কল্পনা। জীবনের শেষে একটু শান্তিতে কাটাতে চাই, এ আরো বড় অলীক কল্পনা। শান্তি দিয়ে শুরু না করলে শান্তি দিয়ে শেষ হয় না। শান্তি গন্তব্য না, শান্তি পথ। আমি যদি নিজে শান্তির রাস্তায় না চলি, নিজের মধ্যে শান্তির আখড়া তৈরি না করি, তবে কাশী-মক্কা-ভ্যাটিকান সিটি কোথাও পাব না। খানিক বিরাম পেতে পারি। কিন্তু শান্তি আরো মূল্যবান জিনিস। শান্তির সঙ্গে তুল্য কিছুই নেই।
কিন্তু শান্তি এমন এক জিনিস তাকে চাইলে পাওয়া যায় না। ইম্যানুয়েল কান্ট লিখছেন আমি তোমায় সুখী করতে পারব না, কিন্তু তোমায় সুখী হওয়ার যোগ্য করে তুলতে পারি। কীসে আসে আসে যোগ্যতা? ওই এক কথা, সব সদগুণের যা মূল আকর - নির্লোভত্ব। লোভ থাকলেই ঈর্ষা থাকবে। ঈর্ষা থাকলেই বুদ্ধি কুটিল-জটিল হবে। বুদ্ধি কুটিল-জটিল হলেই জীবন কানাগলিতে নিঃসংশয়ে ঢুকে যাবে। ব্যস, তারপর "আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া"।
রবীন্দ্রনাথ "শান্তিনিকেতন" প্রবন্ধটার এক একটা অধ্যায় প্রতিদিন উপাসনার পর পড়ে শোনাতেন। একদিন বলছেন, এই যে আমি তোমাদের সামনে রোজ পড়ি, এ আমার লোভ নয় তো? ভালো ভালো শব্দ গেঁথে তোমাদের বাহবা পাব বলে রোজ বসছি না তো?
এইভাবে সচেতন হতে থাকতে শেখাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। এতটাই সচেতন। বাইরের জগতকে আমি ভোলাতেই পারি, কিন্তু মনে মনে আমি কী সে তো কেবল আমি একাই জানি। আমার কাজের উদ্দেশ্য লোভ নয় তো? নামযশ-খ্যাতিপ্রতিপত্তি-টাকাপয়সা ইত্যাদি নয় তো?
আজ যে যুগে আমরা বাঁচছি তা অর্থবলের দ্বারা নিয়মিত। সদ্য ঘটে যাওয়া এক অতিধনী পরিবারের বিয়ে দেখিয়ে দিল অর্থ থাকলে কাকে না নিজের আঙিনায় পাওয়া যায়। বিত্তের অসংযত প্রকাশ সুশিক্ষার, সু-রুচির পরিচায়ক কখনও নয়। কিন্তু এ আজকের ঘটনা তো নয়। চিরটাকাল এইভাবেই হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা জানে কাকে টাকার টানে টানা যায়, কাকে যায় না। সূত্র সেই লোভ।
এতো গেল ধনীর লোভের কথা। যে লাইমলাইট চাইছে। কিন্তু যে মানুষ দারিদ্র্য থেকে উঠতে চাইছে তাকে যদি লোভের ভূত বশ করে তার পরিণাম কী ভয়ংকর হয় তাও তো দেখছি। ক্রমে সোজা রাস্তা ছেড়ে সে বাঁকা পথের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। যদি বা বাঁকা পথ নেওয়ার মত দুঃসাহস না থাকে তবে ক্ষোভ-অধৈর্য্য তে এত বেসামাল হয়ে পড়ছে যে পায়ে পায়ে হতাশা বিষাদের পাঁকে আটকাচ্ছে। পরিশ্রম আর ধৈর্যকে ছেড়ে সে শর্টকাট খুঁজছে। না পেলে জীবন শেষ করে দিচ্ছে।
জীবনে শুধু একটা চেষ্টা থাকলেই হয় না। একটা সাধনও দরকার। চেষ্টা নিজের দিকে তাকিয়ে করা হয়। তার সবটুকুই নিজের জন্য। সাধন বড়র দিকে তাকিয়ে করা হয়, মহতের দিকে তাকিয়ে করা হয়, নিজেকে উদ্ধারের জন্য। নিজেকে অধগতির থেকে উদ্ধারের প্রয়াসই সাধন। দুর্ভাগ্যবশত সে সাধনের জন্য পরিবেশ বা উৎসাহের একান্ত অভাব চারদিকে। অবশ্য সে দিন কোনো কালেই কি ছিল? হয় তো না।
টেন কমেন্ডমেন্টসের শেষ আদেশ আর উপনিষদের প্রথম বাণীর সুরটা এক। খ্রীষ্ট বলছেন এ জগতে যে শান্তির প্রতিষ্ঠাতা সে-ই আমার প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তুমি সংসারে আছ বলে খানিক শান্তি আছে, এ খুব বড় কথা। শেষে আবার বলি, শান্তি গন্তব্য না, পথ। শান্তি বাইরে থেকে পাওয়া যায় না। ভিতর থেকে জন্মায় সে। শান্তিকে প্রত্যক্ষ পাওয়া যায় না। লোভকে সবিবেক সরালেই দেখা যায় সে চিরটাকাল আছে। আর চিরন্তন আছে বলেই মানুষের এতবড় আশা - একটু শান্তিতে মরতে চাই। অর্থাৎ শান্তি এমনই মহার্ঘ্য, তাকে মৃত্যুর পাশেও চাই। তাকে কি এমনিই ফাঁকিতে এলেবেলে ভাবে পাওয়া যায়? সাধনহীন হয়ে কাটিয়ে দেব? দশটা মানুষকে ভুলিয়ে কী হবে, যদি নিজের ভিতরেই আনন্দ-প্রবাহিনীকে খুঁজে না পাওয়া গেল? বাইরের শতসহস্র উপঢৌকন, শিরোপা, নামযশ সব তুচ্ছ হবে যে!