জগৎ সংসারটা আমার বুদ্ধি-বোধের ক্যানভাসে? না আমার বুদ্ধি-বোধ জগৎ সংসারের ক্যানভাসে? এই নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দীর্ঘদিন লড়াই চলেছে। আজও চলছে। যারা বলেন, আমার বুদ্ধি-বোধের ক্যানভাসে জগৎ তারা হলেন 'মেটাফিজিসিস্ট'। আর যারা বলেন, আমার বুদ্ধি-বোধ জগতের ক্যানভাসে তারা হলেন 'এম্পিরিসিস্ট'। লড়াই প্রাচীন। পথ সুগম্য নয়। ভারতীয় দর্শনের মূলধারা মেটাফিজিসিস্টের দিকে, নিজের মত করে।
সত্য কি? প্রাচীনতম প্রশ্ন। উত্তর নেই। কারণ প্রশ্নটা ভুল। যদি বলি, এ শরীরের সত্যটা কি? বলব সেল থিওরির কথা। যদি বলি, এই এক বিন্দু জলের সত্য কি? বলব এইচ টু ও -এর কথা। যদি বলি, আকাশ যে নীল, তার সত্যটা কি? বলব আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের কথা।
তারপরেও যদি হঠাৎ করে জিজ্ঞাসা করা হয় আবার, সত্যটা কি? তখন বুঝতে হবে, সত্যের সত্যটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। সত্যের সত্য কি? প্রশ্নটা কি হেঁয়ালি মাত্র? কোনো কনটেক্সট ছাড়া কি সত্যের সংজ্ঞা, গুণগতমান হয়? হয় না। তবে প্রশ্নটার আরো গভীরের অর্থ হল, আমার অস্তিত্বের সত্য কি? অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তার কারণ আমাদের মন। আমরা আমাদের মনের অস্তিত্বকে পৃথক স্বনির্ভরভাবে জানি। যদি শুধু শরীরের জ্ঞানই আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের সবটুকু হত তবে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমাদের মনের স্বনির্ভর অস্তিত্ব আমাদের সংশয়ে ফেলে। তবে কি আমাদের শরীরের শর্ত ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্ব আছে? কগনিটিভ সায়েন্স, নিউরোসায়েন্সের এই নিয়ে কোনো অবিসংবাদিত মত নেই আজ অবধি।
আমাদের বস্তুজ্ঞান আর আত্মজ্ঞানের একটা সাম্য রাখার কথা ছিল। আমাদের বস্তুজ্ঞান শিখর ছুঁয়েছে। আমরা পদার্থকে বিশ্লেষণ করে, শরীরকে বিশ্লেষণ করে, অজস্র ঘটনার পারম্পর্য (Cause and Effect) খুঁজে পেয়ে আমাদেরকে বস্তুজগতে অনেক অনেক বেশি প্রভাবশালী তৈরি করে ফেলেছি অবশ্যই; কিন্তু আমাদের আত্মজ্ঞানের দৈন্য দিন দিন এত প্রকট হয়ে পড়ছে যে, আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ক্রমশ যেন একটা জড়ের নিয়মের বশবর্তী হয়ে পড়ছে। আমরা সর্বত্র বিশ্লেষণাত্মক হয়ে পড়ছি, আমরা সর্বত্র পারম্পর্য খুঁজছি, কিন্তু আমরা সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার তাগিদ হারিয়ে ফেলছি। মানুষ নিজেকে বিশ্লেষণ করে ততটা জানতে পারে না, যতটা অন্যের সঙ্গে সমন্বয়ের যোগসূত্র খুঁজে নিজেকে আবিষ্কার করে।
আমার মধ্যে বিশ্লেষণের তাগিদ আর যোগসূত্র খোঁজার তাগিদ একসঙ্গেই আছে। যোগসূত্র খোঁজার তাগিদকে আমরা বলি ভালোবাসা, সহানুভূতি, অনুকম্পা, সহমর্মিতা ইত্যাদি। এ মানুষের নৈতিকবোধ। একে বিশ্লেষণ করা যায় না। এ সার্বজনীন। নোম চোমস্কি বলছেন, হাত-পায়ের মত নীতিবোধ সার্বজনীন, কিন্তু কোথাও পুষ্ট, কোথাও পুষ্ট নয়। তা ছাড়াও তা নির্ভর করছে কিভাবে আমি তা ব্যবহার করছি। ক্রিস্টোফার তার ‘মরাল অরিজিন’ বইতে দেখাচ্ছেন কিভাবে নীতিবোধ অভিব্যক্তির হাত ধরে ধীরে ধীরে জন্মিয়েছে। অ্যাডমস স্মিথ তার ‘মর্যাল সেন্টিমেন্ট’ বইতে, হিউম তার ‘এনকুয়ারি অন প্রিন্সিপল অব মর্যালস’ বইতে, কান্ট তার ‘মর্যাল জাজমেন্ট’-এ একই কথা বলছেন। আমাদের নীতিবোধের একটা সার্বজনীনতা আছে।
আমি ভালো হব কেন? এর উত্তর ধর্ম 'পাপের শাস্তি, পুণ্যের পুরস্কার' বিধান দিয়ে একরকম সমাধা করেছে। মানুষ দেখেছে ভালোত্বের মধ্যে এক শান্তি আছে। যা কিছু শান্তি আর সুরক্ষার পক্ষে তাই আমাদের বিধানে ভালো - হিউমের মতে। মানুষ যখন ভালোর প্রতি সামাজিক আর আত্মিক সমর্থন লাভ করে তখন তার অন্তর্দ্বন্দ্ব থেমে যায়। শান্তি পায়।
কিন্তু সত্যিই কি সেই শান্তি গভীর? তার মূল কি এতটাই শক্ত? না। অনেক সময়েই সামাজিক রীতিনীতির উপর বিশ্বস্ততাটাই আমাদের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। মানে একটা কাস্টমসকে মেনে চলাই আমার মনে হতে শুরু করে যেন নিজেকে শান্তিতে আর সুরক্ষিত রাখার একমাত্র উপায়। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? নীতি কি সত্যিই দেশ-কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ?
এইখানেই বাংলা শব্দের যাদু আছে একটা - 'রীতিনীতি'। 'রীতি'টা দেশকালে সীমাবদ্ধ, 'নীতি'টা নয়। নীতি একটাই - সহানুভবী হও, নিষ্ঠুর হোয়ো না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসটা এই নানা রীতি বদলে বদলে এই মানবিক উদারতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার ইতিহাস। আমরা সভ্য বলতে বুঝতে চাইছি সে বর্বর নয়। সে নিষ্ঠুর নয়। সে তার অন্ধ প্রবৃত্তিদ্বারা চালিত নয়। কিন্তু সে লড়াই এখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি। লড়াই এখনও অব্যহত। সেই লড়াইয়ের পথপ্রদর্শক চিরকালই দার্শনিকেরা, যারা তাদের মণীষার গভীরে মনুষ্যত্বের উদার সম্ভাবনার খোঁজ পেয়েছেন, ঘোষণা করেছেন। খ্রীষ্ট যখন বলছেন, তোমরা তোমাদের পিতার মত হও, তিনি যেমন আমায় ভালোবেসেছেন তেমনি তোমরাও একে অন্যকে ভালোবাসো, তখন তিনি মানুষের মধ্যের সেই সম্ভাবনার কথাই বলছেন, তাকে জাগাতে বলছেন।
নানা সামাজিক রীতি, প্রথা আদি অকৃত্রিম নৈতিকবোধের গলা টিপে ধরতে চায়। তাকে হত্যা করে নিজেকে তার সিংহাসনে বসিয়ে বলতে চায়, আমিই আদি, আমিই শাশ্বত। আমার সভ্যতার নিয়মগুলিই হল সত্য, নির্ভুল; বাকি যা কিছু সব অর্থহীন, ভুলে ভরা। সমাজ তখনই আবার স্থবির হতে শুরু করে। আবার অচলায়তন গড়ে ওঠে। আবার একজন দার্শনিকের আসার সময় হয়ে পড়ে, যে আবার হারানো যোগসূত্রটা খুঁজে দিয়ে বলে, এই যে, এইটাই ছিল মূলকথা, নিজের ভিতর থেকে পাশবিকতা যতটা পারো ঝেড়ে ফেলো, নিষ্ঠুর হোয়ো না। এই হল নীতি। হিংসার দ্বারা হিংসার নিবৃত্তি হয় না, হিংসা নিবৃত্তি পায় প্রেমে, এই হল সনাতন ধর্ম। বুদ্ধ বললেন।
আমাদের নানা বিরোধ, বৈচিত্রের মধ্যে এই একটাই তো দাঁড়াবার জায়গা আছে - আমরা একে অপরকে বুঝতে না পারলেও, সহমত হতে না পারলেও যেন তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত না করি, ক্ষমতা আছে বলেই। মানুষের ক্ষমতা তো একটাই, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। ন্যায্য ব্যবহার। যাকে 'জাস্টিস' বলে।