সৌরভ ভট্টাচার্য
12 May 2018
অনুপ্রেরণার একটা গতি থাকে। সে গতির দিক থাকে, অর্থ থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাকে কেউ যদি অনুপ্রাণিত করে থাকেন তবে সে অনুপ্রেরণা তাতেই গিয়ে শেষ হবে এ কেমন কথা? আমার যাত্রা যদি রবীন্দ্রনাথে শুরু হয়ে থাকে আর সে যাত্রা যদি রবীন্দ্রনাথেই শেষ হয়, তবে নিজেকে ব্যর্থ তো করবই সাথে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শটাকেও ব্যর্থ করব। তেমনই সঙ্গীতেও। আমি যদি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকি উস্তাদ আমির খাঁ-এর স্বর্গীয় মাধুর্যে তবে সে অনুপ্রেরণা আমায় চলতে ফিরতে কত কিছুর মধ্যে যে সঙ্গীতের আস্বাদন করাবে তার ইয়ত্তা নেই। নাকি আমি কূপমণ্ডূক হয়ে বসে থাকব? এই ভাবেই তৈরি হয় গোঁড়ামির ভিত পতন। সেও এক অনুপ্রেরণা, তবে জড় অনুপ্রেরণা। সে এমন একটা বাড়ি বানায় যার দরজা জানলা সব একমুখী। সে ভিতরে আসতে দেয়, কিন্তু বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। তার বাড়ির মধ্যে থাকে একটা মন্দিরের মত কিছু, তার পূজো চলে, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণ চলে না। তার বাড়ির প্রতিটি আনাচে-কানাচে সেই অনুপ্রেরণার উপস্থিতি। সে বাড়ি যেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাসটাকে অনেকে নিষ্ঠা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। পায়ে যত ঝিঁঝিঁ ধরে সে তত লোককে ডেকে তার জড়তার গুণগান করে। বলে, সংসারে মূল্যবান বলে যদি কিছু থাকে তবে অমুক বস্তুটি।
এবার বাইরে থেকে যদি ঘটনাটা দেখি। মানুষ জানে পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। কিন্তু বৈচিত্র্যকে বৈচিত্র্য হিসাবে দেখতে গেলে চিত্তবৃত্তির যে স্বাস্থ্য ও চর্চা লাগে, তা অনেকের ক্ষেত্রেই অবহেলিত থেকে যায় আজীবন। বৈচিত্র্যকে সে তখন দেখে নিষ্ঠাহীনতা হিসাবে। ভয় পায়। তার দুর্বল চিত্ত যত বৈচিত্র্যের বিচিত্রতায় কেঁপে কেঁপে ওঠে, নিরাপত্তাহীনতায় আর নিশ্চয়তাহীনতায় ভোগে, সে তত হিংস্র হয়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অথবা সুকৌশলী হয়ে ওঠে। মোট কথা তাকে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের বিচিত্র কোলাহলের বাইরে গিয়ে একটা নির্দ্বন্দ্ব বিশ্রামাগার না খুঁজে পেলেই নয়। এ হেন মানুষের পক্ষে ওই গোঁড়া অনুপ্রেরণামুগ্ধ দল একটা মরুদ্যানের কাজ করে। তারা বলে, দাদা আপনিই যা হোক একটা কিছুকে অন্তত ধ্রুব পেয়েছেন এই হুসমান জগতে। এখানে তো চোখের পলক পড়তে না পড়তেই হুস করে সব বদলিয়ে যায় গো দাদা।
এই হল দুর্বলের বাসা। দুর্বলের বিশ্বাস। দুর্বলের গতি। সত্য অর্থে অনুপ্রেরণার গতিতে ছুটি নেই। সেই ‘ছুটদাদু’র মত সে দশদিক ঘুরিয়েই ছাড়বে। আমার খেদের সীমা নেই যে আমি পৃথিবীর সব ক’টা ভাষা পড়তে পারি না। বুঝতে পারি না। তাই ইংরাজি ভাষার দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা ভাষায় নানা মানুষের একই মানবিকতার গল্প শুনতে শুনতে কেমন ঘোর লেগে যায়। মনে হয় আপেল কেন মাটিতে পড়ল তা না জানতে পারলেও আমার চলবে, কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের কথা যদি অধরা থেকে গেল, মানুষের মাধুর্য যদি না পেলাম, তবে সব ব্যর্থ। শুনতে শুনতে মনে হয়, মানুষের কথাতেই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের সুর দেখছি। এ এক নিরবিচ্ছিন্ন কালের স্রোত। আমিও একটা বুদবুদ তার। মনে হয় অনন্তকাল ধরেই এই সংসারে আছি। জানি না এরকম কোনো একটা অনুভব থেকেই জন্মান্তরের ধারণা মানুষের মনে জন্মেছিল কিনা। হাজার বছরের পুরোনো কোনো লেখায় যখন নিজের মনের কোনো একটা রঙের আভাস দেখি, মনে হয় যেন যে মন নিয়ে জন্মালুম সে যেন আমার আগের থেকেই জন্মে আছে। নইলে আমার জন্মের আগেই তার এই অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ হল কি করে? আবার এই সাদৃশ্যতাতেই মানবিকতার বীজ। আমরা যে একইরকম। আমাদের মধ্যে যে একই সূত্র। এই আদিম অনুপ্রেরণা।
বয়েস যত বাড়ছে তত মানুষের চলে যাওয়ার সাক্ষীও তো হচ্ছি। যার সাথে কথা হল দু’দণ্ড সারা জীবনে যেদিন শুনি সে মানুষটা আর নেই, সেদিন ক্ষণিক হলেও এক শূন্যতা বুকে খামচে ধরে। সে শূন্যতায় আবার ভালোবাসাকে নতুন করে স্নান করিয়ে বসাই। বলি, আমায় পূর্ণ করো। এই সাম্যহীন সংসারে সাম্যতার সংগ্রাম যদি কেউ করে থাকে সে ভালোবাসাই। ওই যে বললাম মানবিকতা। সেই মানবিকতার শাঁস তো এই ভালোবাসা। অনুপ্রেরণা। মানুষ ছবিতে, গানে, শব্দে এই একটাই কথা বলবার চেষ্টা করছে তো। যেখানে সে সফল হচ্ছে সেখানে সে বিশ্বের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাকি তো সব গয়ংগচ্ছ – সেও আছে।
তো যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। গতি আর অনুপ্রেরণা। আমাকে যে-ই সঠিক অনুপ্রাণিত করে সে আমায় একটা গতি দান করে। সে গতির পথ বিচিত্র। একটা তৃষ্ণা। “ফিরি আমি উদাস প্রাণে/ তাকাই সবার মুখের পানে/ তোমার মত এমন টানে কেউ তো টানে না”। আমাদের শাস্ত্রে পড়েছি পরীক্ষিতের কথা। তিনি নাকি মাতৃগর্ভে একবার ঈশ্বরের মাধুর্যের আস্বাদ পেয়েছিলেন। তারপর জন্মাবধি সেই আস্বাদনের জন্য পরীক্ষা করে বেড়িয়েছেন সক্কলকে, তাই তার নাম হয়েছিল পরীক্ষিত। যিনি শুকদেবের কাছে একটা বড় কথা শুনেছিলেন – ভাগবত। মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে। কবি সেখানে শুকদেবের মুখ দিয়ে একটা বড় কথা বলিয়ে নিয়েছেন – ঈশ্বরকে যদি ভালোবাসতেই হয় তবে অকারণেই বেসো, হাত পেতো না, হাত উপুড় করো। এ কথাতে অবিশ্বাসীর প্রাণেও দোলা লাগে যে! “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান/ দাও, আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল”।
একেই বলি অনুপ্রেরণা। “আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে/ আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি যে তার শোকে/ আমি আছি সুখে হাস্যমুখে দুঃখ আমার নাই”। এই গতি পালে লাগুক। বাইরের জল আসুক। নাহয় কিছু নোনাজলও আসুক। আমরা বেছে নেব। সুস্থ শরীর যাই খায় তার থেকে সু-কে নিয়ে কু-কে বর্জন করে। সুস্থ মনও তাই। অসুস্থ শরীরেরই হাজার একটা শাসন, বিধি। কারণ সে ফারাক করতে জানে না। আমরা কি থোড়ি অসুস্থ? লাগুক পালে হাওয়া। আসুক না হয় বেনোজল। আমরা বুঝে নেব। খালি অনুপ্রেরণার নামে ভিটামিন আর খাবো না, খোলা মাঠে যাব। “ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি”।