অভিমান দুর্বলের রাগ। সে যতই কাব্যিই অভিমান নিয়ে হোক না কেন, আদতে যে দুর্বল, অভিমান তারই হয়। যে নিজেকে ভাবে অশক্ত, অক্ষম তারই অভিমান হয়। সে নিজেকে উপেক্ষিত, বঞ্চিত ইত্যাদি নানা কিছু ভেবে ভেবে রোষানলে পুড়ে মরে। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়? হয় না।
অভিমান করার স্বভাব আমাদের এমন চারিয়ে ছিল যে এক সময় সাহেবদের উপরেও আমাদের থেকে থেকে অভিমান হত। রবি ঠাকুর গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে আমাদের দিতেন কান ধরে নাড়া। তাতে কাজ কিছু হত কিনা জানি না অবশ্য। তবে অভিমান করা বাঙালিদের মনে হয় এক জাতীয় দোষ।
আমাদের সবার উপর অভিমান। ঈশ্বর থেকে শুরু করে নেতা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, প্রেমিক, বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। কার উপর না অভিমান হয় আমাদের। সবার উপর। মায় নিজের উপর অভিমানও দেখেছি।
অভিমান হলে কি হয়? শান্তি নষ্ট হয়। তিলকে তাল করে, দেওয়ালকে এভারেস্ট করে, নিজেকে নিশ্চল, নিশ্চেষ্ট করে, কি এক তামসিক অভিভূতিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা হয়। এতে কি কিছু মঙ্গলের হয়? হয় না।
অভিমানের মধ্যে একটা মিথ্যা আছে। আর মিথ্যার মধ্যে একটা মিথ্যা সুখ আছে। মিথ্যাটা কিরকম? অভিমানের মাধ্যমে অভিমানী নিজের একটা গুরুত্ব খুঁজে বার করে। মানে আমায় যতটা গুরুত্ব তোমার দেওয়া উচিৎ ছিল, ততটা দাওনি, তাই আমার অভিমান হয়েছে। এই অভিমান হল সেই না-গুরুত্ব পাওয়ার অনুভবকে যুঝে নেওয়ার জন্য নিজের মধ্যে নিজের গুরুত্ব নিয়ে একটা আবেশ সৃষ্টি করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবের চাইতে বেশি হয়ে পড়ে স্বাভাবিক। কারণ মানুষের স্বভাবে এ দোষটা আছেই, সে নিজের মূল্যায়ন নিজে করতে গেলে অতিরিক্ত মান দিয়ে ফেলে, আবার অন্যের মূল্যায়নের বেলায় কম দিয়ে ফেলে। এ স্বাভাবিক। কিন্তু ন্যায্য নয়। অগত্যা অভিমানের মধ্যেও অনেকটাই অন্যায্য হিসাবনিকাশ ঢুকে এক অবাস্তব অনুভবের রাজ্যে অভিমানীকে নিয়ে যায়, আর সে রাজ্যের অলীক সুখে অভিমানী ভাসতে ভাসতে ভাবে, আহা, এ অবস্থাটা না কাটলেই তো ভালো। আমার মান ভাঙাবার যত চেষ্টাই করা হোক কেন, আমি আমার অভিমানের কণামাত্র হলেও রেখে দেব। সংসারে অন্যভাবে আমি আমার গুরুত্ব বোঝাতে না পারি, অন্তত এই প্রকার গুমোর দেখিয়ে তো পারি।
অভিমান ক্রমে ক্রনিক জেদে পরিণত হয়। থেকে থেকেই অভিমানের সুখে অভিমানী ডুবে যায়। গোটা সংসার যে তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ নিয়ে তার সংশয় থাকে না। বাস্তব জগতের থেকে সরে গিয়ে এমন এক জগতে সে বাস করে যেখানে সবটাই শীততাপনিয়ন্ত্রিত। মানে সে চাইলেই সে জগতের সব কিছুকে নিজের মত করে নিতে পারে। কারণ সে জগতে সবাই তার নিয়ন্ত্রণে, যদিও তা কল্পনায়।
সংসারে অল্পবিস্তর অভিমান তো থাকবেই। কিন্তু সে নিয়ে কথা না, অভিমান করাটা যখন অসুস্থতায় দাঁড়িয়ে যায় তখন তা আর সুখকর থাকে না। যে প্রত্যক্ষ ভোগে, আর তার জন্যে যে বা যারা পরোক্ষভাবে ভোগে, তাদের কারোর পক্ষেই সেটা আর কাব্যিক জায়গায় থাকে না। সে রীতিমতো অসুস্থতার জায়গায় নিয়ে যায়। সার্ত্রে তার বিখ্যাত বই, 'বিং অ্যাণ্ড নাথিংনেস'-এ যে 'ব্যাড ফেথ'-এর কথা বলেছেন, আমার মনে হয় কিছুটা এই বোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার কিছু হবে না, আমার দ্বারা এটা সম্ভব নয়, এ যেন কোথাও নিজের উপর অভিমান থেকে জন্মায়।
সমস্যাটা হল তথাকথিত 'ছোটোখাটো' সমস্যাকে আমরা ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। বাড়তে দিই। যতক্ষণ না সেটা আরো গভীরে শিকড় চারিয়ে নিত্য জীবনকে প্রায় অকেজো করে ফেলে। অভিমান শব্দটা আপাত যতটা নিরীহ মনে হয়, আদতে কি ততটাই? কত মানুষ অকালে চলে যাওয়ার পর আমরা বলি, ওনার ভীষণ অভিমান ছিল অমুকের প্রতি, তমুকের প্রতি। যেন এই অভিমান শব্দটা দিয়েই তার অকালে অস্বাভাবিকভাবে চলে যাওয়াটাকে জাস্টিফাই করে ফেললাম। সেটা কি ঠিক?
আপাত নিরীহ এই স্বভাবকে নিয়ে যতটা ভাবনাচিন্তা আবশ্যক, যতটা গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক, তা যদি সময়ে না দেওয়া যায়, তবে তা অবশ্যই তার পরিণাম আখেরে ভালো হয় না। অভিমান শুধু গান, কবিতা বা প্রেমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়, এ রীতিমতো একটা মানসিক ব্যাধির জায়গা নিতে পারে, বা অন্তত সিরিয়াস কোনো মানসিক ব্যাধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, এ ভাবনাটা মাথায় রাখা আবশ্যক।