Every passion is mortified by it (scepticism), except the love of truth - David Hume
‘শ্রদ্ধা’র বিপরীত শব্দ ‘সংশয়’। সংশয় বলে, তাই কি? শ্রদ্ধা বলে, তাই। একবার বলছেন, ‘সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে’, আবার বলছেন, ‘সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা’। আবার বলছেন, “যেদিন সংশয়ের ক্রন্দন আমাদের মধ্যে সত্য হয়ে ওঠে, সেদিন আমরা সম্প্রদায়ের মত, দর্শনের তর্ক ও শাস্ত্রের বাক্য নিয়ে আরাম পাই নে; সেদিন আমরা একমুহূর্তেই বুঝতে পারি প্রেম ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই --- সেদিন আমাদের প্রার্থনা এই হয় যে, "প্রেম-আলোকে প্রকাশো জগপতি হে।"
দুটো কথা হয়, এক, সংশয়ের দহন, আর এক সংশয়ের সুখ। সংশয় যদি সত্য অন্বেষণের জন্য হয়, তবে অবশ্যই তা সুখাবহ নয়। কিন্তু সংশয় যদি শুধু যা আছে তাকেই সংশয় করি, তাতেই আমার সুখ - এই হয়, তবে সেখানে গোলমাল। তখন তা বাতিক। তখন তা কুতর্ক। “আমি কিছুই বিশ্বাস করি না” - এও এক বিশ্বাস। “আমি সংশয়বাদী” - এও এক বিশ্বাস। যে কোনো ‘বাদ’-এ বিশ্বাস করাই একপ্রকার বিশ্বাস। যা কিছুকে সংশয় করা এবং সত্য উপনীত হওয়ার তাগিদ হল সত্য অর্থে সংশয়বাদের তাগিদ।
সংশয় আর বিশ্বাস - অবশেষে দুই একটা অভিজ্ঞতায় এনে দাঁড় করায়। সংশয়বাদের খুব কাছাকাছি একটা শব্দ ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’।
বুদ্ধ তাঁর দর্শনের তিনটি খুব বড় স্তম্ভ রাখলেন। এক, অনিত্যতা। সব কিছুই অনিত্য। এই বোধকে নিজের চিত্তে ধারণের অভ্যাস। দুই, দুঃখ। এটি আর্যসত্যও বটে। জীবন মানেই দুঃখ। তিন, অনাত্মা। কোনো কিছুই আত্মা নয়, 'আমি' নই। সব ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর।
শঙ্কর যখন সব কিছুকে ‘নেতি নেতি’ করে দেখতে চাইছেন, তখন এই শেষের কথাটা প্রকট হয়ে যায়। কিছুই আমি নই। আমার অস্তিত্ব একটা সিন্থেটিক অস্তিত্ব। এর কোনোটাই 'আমি' বলতে যা বুঝি তা নই। শঙ্করকেও তাই বৌদ্ধ বলা হল। সরাসরি না বলে ‘প্রচ্ছন্ন’ শব্দটা যোগ করে দেওয়া হল।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কি সংশয় সম্ভব? না। যা আমার বোধের বাইরে তা নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব নয়। কিন্তু নানা মত, যা ধর্ম নামে প্রচলিত, তা নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। তার প্রতিটা খুঁটিনাটি নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। নানা মতাবলম্বী পবিত্র গ্রন্থ নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। পবিত্রতা শুদ্ধতার ধারণা এক-এক দেশের আচার প্রথা অনুযায়ী এক-একরকম। সে সব নিয়েও প্রশ্ন চলতে পারে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি নিজেকে ঈশ্বর আছেন কি নেই, তবে এর উত্তর একটাই - নীরবতা।
সংশয়, বিশ্বাস - দুটোই ততক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, যতক্ষণ সে আমাদের কমোন সেন্সকে অতিক্রম করার চেষ্টা না করছে। অন্ধবিশ্বাসকে অতিক্রম করা আর শুভ আর মঙ্গলকে বিশ্বাস করা, দুটোই দরকার। যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গলজনক তার সঙ্গে অতীন্দ্রিয় কিছুর যোগাযোগ নেই। সব সত্য তৎক্ষণাৎ ভেরিফায়াবেল নয়, সব পদক্ষেপ আশু লাভজনক নয়, তবু বিশ্বাস করতে হয় যে মানুষের মঙ্গল তাতেই। অর্থনীতি, সমাজের নানা নীতি এরকম একটা বিশ্বাস থেকেই শুরু হয়, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা দেখা হয় আদৌ বাস্তবসম্মত হচ্ছে কিনা। তবেই তা কার্যকর হয়। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ একটা বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় - এতে মঙ্গল হবে।
আমরা যে গণতন্ত্র, যে সমাজতন্ত্রের মধ্যে বাস করছি সেটা পার্ফেক্ট তো নয়। কিন্তু এই বিশ্বাস আছে যে এতেই আমরা আমাদের জীবন থেকে সর্বোচ্চ সার্থকতা খুঁজে নেব। এ বাস্তব না হলেও, এ বিশ্বাস। এ না হলে মানুষ পাগল হয়ে যেত। নিত্য জীবন ধারণের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। ট্রেনের ড্রাইভার, প্লেনের পাইলট, ওষুধের কোম্পানি, দোকানের খাবার, বাড়ির স্থায়িত্ব, ব্রীজের স্থায়িত্ব --- এসব যেমন বাহ্যিক বিশ্বাস। যা শুনছি, যা দেখছি, যা বুঝছি, যা যুক্তি সাজাচ্ছি, তাছাড়াও নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রণালীর উপর বিশ্বাস ইত্যাদিও আমাদের নিত্য বিশ্বাসের অঙ্গ।
এরপর নানা সামাজিক বিশ্বাস তো আছেই, বাবা, মা, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, চিকিৎসক তো আছেনই।
এ সবে সংশয় করে মানুষ বাঁচে কি করে? হয় তো শারীরিকভাবে বাঁচে, কিন্তু মানসিকভাবে তো সে নিঃস্ব। তার উদাহরণই যে নেই সংসারে তা তো নয়। সেও আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও আছে।
তবে সংশয়ও দরকার। কোথায় বেশি দরকার? যে অথোরিটি হতে চাইছে, তার সামনে মাঝে মাঝেই ভুরু কুঁচকে দাঁড়ানো দরকার। আলফা মেলকে মাঝে মাঝেই চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার। যদি সে চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে, সে আমার নেতা হওয়ার যোগ্য, যদি সে আমার চ্যালেঞ্জকে অস্বীকার করে, তবে সে আমার নেতা হওয়ার যোগ্য নয়।
চীন, রাশিয়া বা কিমের কোরিয়া যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে বিশ্বাসের জায়গায়। সেখানে বিশ্বাস করতেই হয় যে আমার আলফা মেল সেই শ্রেষ্ঠ। সে আমার সংশয়কে ভালো চোখে দেখে না। সেদিন আমাদের বিচারপতি ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। এই প্রশ্ন করার সাহসটাই, সংশয় জাগার সাহসটাই আমার অধিকার। অথোরিটির সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্যই। যারা শুধুই সংশয় প্রকাশ করে, করবে বলেই করে, খবরের কাগজে তাদের বক্তব্য আমরা এড়িয়ে যাই। কারণ জানি যে সত্যের অবস্থানের চাইতে সংশয়ের অবস্থানকে শ্রেয় বলে মনে করে বসে আছে। সংশয়জীবী সে। সত্যজীবী নয়।
আমাদের আজকের যুগে ঈশ্বরে বিশ্বাস বড় কথা নয়। আমাদের যুগে বড় কথা হল, নানা সোশ্যাল মিডিয়াসহ, নানা ইন্টারনেটের বিষয়ে অগাধ বিশ্বাস। যদি কেউ দণ্ডী কেটে তার পেটের ব্যামো সারবে বলে সারা রাস্তা যায় আমার ভয় লাগে না তত, যত কিনা এই সব 'সোশ্যাল মিডিয়ায় যাহাই পড়ি তাহাই সত্য' গোছের পাব্লিকদের দেখলে ভয় করে।
এত বিশ্বাসী হলে তো বিপদ। আমাদের যুগে একটা বড় সমস্যা এই ফেক নিউজ, পোস্ট ট্রুথ, কালারড ট্রুথ, বায়াসড ট্রুথ, ফেক ট্রুথ। হুম, সবই অক্সিমোরন। কিছুরই স্থায়িত্ব নেই। কিন্তু ঘূর্ণি সৃষ্টির ক্ষমতা প্রবল। কিছুই পড়ব না, মূল বই পড়ব না, এদিকে সব নিয়ে গলা ফাটিয়ে তর্ক করব, এ হয় তো এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই সম্ভব। ছোটো ছোটো কলতলা; ছোটো ছোটো গ্রুপ; ছোটো ছোটো আহ্লাদ; ছোটো ছোটো সুখ। এ বড় সমস্যা।
অগত্যা স্বামীজির কথাটা মনে রাখবেন, "ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে যাহাই পড়িবে তাহাই বিশ্বাস করিও না", এটি উনি শিকাগো স্পিচ দেওয়ার পর, রমণ মহর্ষিকে টেক্সট করেছিলেন। হল?
বিশ্বাসে মিলায় পার্ক, সংশয় মহাডার্ক
সোশ্যাল মিডিয়া রূপ ধরি আসিয়াছে নোয়ার আর্ক।