সারদাদেবী বরাবরই আমাকে বিস্মিত করেন তাঁর সাধারণ অথচ গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং তাৎক্ষণিক সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায়।
একজন এসে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেবের সুখ্যাত করতে গিয়ে বলছেন রামকৃষ্ণদেবের অভূতপূর্ব ধর্মসমন্বয়ের কথা।
মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছেন, "তিনি তো মতলব করে কিছু করেননি, ওসব হয়ে গেছে। তার আসল শিক্ষা, দৃষ্টান্ত হল ত্যাগ।"
ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে ভুলটা সেদিন উনি শুধরে দিয়েছিলেন সে ভুলটা আজও চলছে, বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণায়, আলোচনায়।
সমন্বয় করতে গেলে একটা উদ্দেশ্য থাকে --- সামাজিক, কি রাজনৈতিক। রামকৃষ্ণদেবের প্রশ্ন ছিল, কৌতূহল ছিল, জিজ্ঞাসা ছিল, কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাই রামকৃষ্ণদেবের চেষ্টায় কোনো সচেতন সমন্বয়ের চেষ্টাও ছিল না।
তবে রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে কি ছিল? ছিল বহুত্ববাদ। রামকৃষ্ণদেব ধর্মের সমন্বয় করেননি, করতে চানও নি। তিনি যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা হল ধর্মের বহুত্বের বাস্তবতা।
উদাহরণ এক - মা বাড়িতে মাছ এনেছেন, যার পেটে যা সয় তাই রাঁধছেন, কারোর জন্য কালিয়া, কারোর জন্য ঝোল, কারোর জন্য ভাজা।
উদাহরণ দুই - একটা পুকুরের চারটে ঘাট, কেউ বলছে ওয়াটার, কেউ বলছে পানি, কেউ বলছে জল, কেউ বা অ্যাকোয়া।
উদাহরণ তিন - বিভিন্ন উপদেশ ও গল্প বলার পর বলছেন, আমি যা বলার বললুম, তোমরা লেজা-মুড়ো বাদ দিয়ে নেবে।
উদাহরণ চার - একটা গাছে একটা গিরগিটি থাকতো। সেই গিরগিটিটা এক-এক সময়ে এক-এক রঙ ধারণ করতো। যে যে রঙে দেখেছে সে সেই রঙকেই চূড়ান্ত বলে মেনেছে।
উদাহরণ পাঁচ - এখানকার ভাব একঘেয়ে নয়।
কোথাও রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে সমস্তকে মিলে এক করার প্রবণতা নেই। বরঞ্চ রামকৃষ্ণদেবের আরেকটা উদাহরণ টেনে বলা যায়, "যে যেই রঙে ছুপতে চায়, তাকে সেই রঙেই ছুপাই"।
বিখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদ John Rawls একটা শব্দ আবিষ্কার করেছিলেন, reasonable pluralism, যার অর্থ অক্সফোর্ড রেফারেন্স অনুযায়ী, "Rawls uses the term to denote the fact of a plurality of reasonable, though irreconcilable, moral, religious, or philosophical doctrines". রামকৃষ্ণদেবের 'প্লুরালিজম্' বা বহুত্ববাদেও এক সূত্র অনুযায়ী 'একঘেয়ে' হওয়ার কথা নেই। বৈষ্ণব ধর্মের শুদ্ধাভক্তিবাদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদকে কখনই এক বলছেন না। বলছেন, মানুষের রুচিগত, ভাবগত, বৈচিত্র্যতা অনুযায়ী দুই-ই সত্য। এ সমন্বয়বাদ নয়, বহুত্ববাদ।
অন্যের জিনিস যেমন ধার করা যায় তেমনই অন্যের যুক্তিও ধার করা যায়। নানাবিধ পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ, ভাষণ ইত্যাদি লেখা দেওয়াও যায়। কিন্তু সামগ্রিকতার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ না হলে সেটা অর্ধপাচিত বা অপাচিত হয়ে অস্বাস্থ্যের কারণ হয়। রামকৃষ্ণদেবের দর্শন ধর্মজগতে এক সামগ্রিক দর্শন, সেটা যে জগতের সম্ভবনার আশা জাগায়, সে জগত সঙ্গতিপূর্ণ বহুত্ববাদের।
জন রলস্ যখন এই 'রিজনেবল প্লুরালিজম' প্রয়োগের জন্য একটা সাধারণ ভিত্তিভূমি খুঁজছেন সেখানে তিনি বলতে চাইছেন মানুষের সত্তা ও ব্যবহারের ফান্ডামেন্টাল দিকের কথা। রলস্ বিশ্বাস করেন, স্বভাবগতভাবে মানুষ সহনশীল। এই সহনশীল স্বভাবই "রিজিনবল প্লুরালিজিম" এর ভিত্তি।
মাস্টার মশাইকে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, "আমি ঠিক আর সবাই ভুল এ বুদ্ধি কোরো না, এতে হানি হয়।"
এ হিংসা, অসহিষ্ণুতা, দ্বন্দ্ব, কলহপূর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণদেবের এ দর্শন আশার কথা। কারণ এ শুধু তত্ত্ব নয়, প্রয়োগ উপযোগীও। এ দর্শনকে তিনি ও তাঁর শিষ্যেরা, ভক্তেরা নিজের জীবনে অনুসরণ করেও দেখিয়েছেন।