রমণ মহর্ষি উত্তর দিতেন না। প্রশ্ন করতেন। একজন এসে বললেন, আমি দীর্ঘদিন জপ করছি, কিন্তু আমার প্রাণে কোনো শান্তি নেই। রমণ মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন, কে জপ করছে?
প্রশ্নকর্তা হয় তো বুঝতে না পেরে রমণ মহর্ষির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন; রমণ মহর্ষি বললেন, তুমি খোঁজো কে জপ করছে।
এই ছিল মূল পথ। প্রশ্ন করো – “আমি কে?”। রাতদিন এই প্রশ্ন করো। যে কাজ, যে চিন্তা, যে অনুভব – যার মধ্যে দিয়েই যাও, সে মুহূর্তকে ভেসে যেতে দিও না, নিজেও ভেসে যেও না। প্রশ্ন করো – “কে চিন্তা করছে?”... ”কে অনুভব করছে?”... ”কে দুশ্চিন্তা করছে?”... ”কে সংশয়ে ভুগছে?”... ”কে প্রশ্ন করছে?”...
এ এক খেলা। রমণ মহর্ষি বলছেন না তুমি দীক্ষা নাও, গুরুকরণ করো, সন্ন্যাস নাও, পুজা করো। তোমায় কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি শুধু এই খেলাটা শিখে নাও। যখন সংসারে জট পাকাচ্ছে, তখনই এই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করো। যখন সব কিছু মোলায়েম আনন্দলহরীতে বয়ে চলেছে তখনও এ প্রশ্ন করো। ঈশ্বরকে দরকার নেই, নিজেকে খোঁজো। তোমার গভীর ঘুমের মধ্যে কে জেগে থাকে? কে স্বপ্ন দেখে? কে স্বপ্নকে অনুভব করে? এ তর্কের বিষয় নয়। এ প্রশ্নের বিষয়। এ প্রশ্ন বাইরের কাউকে কোরো না। এ আত্মজিজ্ঞাসা। আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর বাইরে থেকে আসে না।
তবে কি গুরুর দরকার নেই?
রমণ বললেন, তুমি তবে বাইরের গুরুর কথা বলছ। বাইরের গুরুর একটাই কাজ, ভিতরের গুরুকে জাগিয়ে তোলা। ভিতরের গুরু তখন তোমায় ভিতরে ডাকবে। তুমি স্থির হবে। সংসারে দাঁড়াবার পাটাতন পাবে। সংসারে দাঁড়াবার পাটাতনের নাম ঈশ্বর।
কৃপা হয় কি করে?
গুরু, কৃপা, ঈশ্বর – একই সত্তার নাম। তুমি আমায় দেখো। আমার সেই অর্থে গুরু কই? আমি তখন তোমাদের ভাষায় টিন এজার। একদিন কি এক অনুভব হল। মনে হল আমি যেন মৃত। আমার দেহ থেকে আমি বাইরে। আমি আর আমার দেহ আলাদা। আমি বাড়ি ত্যাগ করলাম। এখানে ওখানে ঘুরে এই অরুণাচলম পাহাড়ে এলাম, তামিলনাড়ুতেই। কি এমন সৌন্দর্য যেন এই পাহাড়ের! আমায় তীব্র আকর্ষণ করল। আমি সেই টানে এসে পড়লাম। ধ্যানে বসলাম। মন্দিরে আমায় নিয়ে কৌতুহল হল। আমি মন্দিরের তলায় গুদোম ঘরে ধ্যানে বসলাম। আমার নাকি সারা শরীর পিঁপড়ে-কাটা দাগে ভরে গিয়েছিল। তাতে কি? আমার তন্ময় ধারা রইল নিরবচ্ছিন্ন। আমি আমায় পেলাম। তাই বললাম, গুরু, ঈশ্বর, কৃপা --- সবই এক কথা। নিজেকে প্রশ্ন করো। নিজের খোসা ছাড়াও। 'হো হো' করে বেড়িয়ে সময় নষ্ট করো কেন?
আমার দেবপূজা ভালো লাগে..., একজন এসে বলল।
রমণ বললেন, তাই করো।
একজন এসে বললেন, আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকি। তোমায় বারবার দেখার সাধ, দেখি কি করে?
রমণ বললেন, বোকামি করো কেন? ভিতরে ডোবো। নিজেকে জানো। বাইরের সব পার্থক্য ঘুচে যাবে।
একজন এসে বলল, আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দাও।
রমণ হেসে বললেন, ব্রহ্মজ্ঞান আমি দেব কি করে?
সে বলল, কেন, আপনি যে ব্রহ্মজ্ঞানী!
রমণ বলল, যদি আমি ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে থাকি, তবে আমার কাছে সব ব্রহ্ম, তুমিও, তোমায় আমি কি যুক্তিতে ব্রহ্মজ্ঞান দেব? আর যদি আমি ব্রহ্মজ্ঞানী না হয়ে থাকি, তবে তুমিও যা, আমিও তাই। এসো বরং নিজেরাই নিজেদের রাস্তা খুঁজি। নিজেকে খোঁড়ো। খোঁজা মানে খোঁড়া। আঁশ ছাড়াও।
মহর্ষির তখন স্কিন ক্যান্সার। কোনো বিশেষ চিকিৎসায় না বলে দিলেন। তখন তাঁর পরিচিতি বিশ্বজোড়া। টাইমস্ ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে। কার্ল ইয়ুং -এর মত মনোবিদ তাঁর কথা উল্লেখ করলেন। মহাত্মা গান্ধী মাঝে মাঝেই কাউকে না কাউকে পাঠান পরামর্শ চাইতে। মহর্ষির সবার জন্য অবারিত দ্বার। মহর্ষি কথা বলেন না বেশি। কিন্তু বাচ্চারা ভীষণ প্রিয়।
কয়েকজন আশ্রমের বাচ্চা তাঁর সামনে ধ্যান করছে। আসলে মজা করছে। একটা দুষ্টু ছেলে মহর্ষির সামনে ধ্যানরতা এক বাচ্চা মেয়েকে বারবার খুঁচিয়ে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছে। মহর্ষি মজা দেখছেন, মুচকি মুচকি হাসছেন। এক সময়ে মেয়েটাকে বললেন, তোকে যে খালি খালি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে, কিছু বল...
মেয়েটা শান্ত গলায় মহর্ষিকে বলল, আপনি ভুল করছেন মহর্ষি, ও নিতান্তই আমার শরীরকে স্পর্শ করছে, আমার আত্মাকে না।
মহর্ষি হো হো করে হেসে বললেন, বাব্বা! তোর এত দূর হয়ে গেছে...
একজন এসে বলল, মহর্ষি আমার মনে হয় আমার জন্য আত্মজিজ্ঞাসার পথ নয়, তবে আমি কি করব?
মহর্ষি বললেন, তুমি নিজেকে সম্পূর্ণ ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করো।
সে বলল, সেও করেছি, কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না।
মহর্ষি বললেন, যদি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে থাকো, তবে কোন অংশ থেকে এ অভিযোগ, ক্ষোভ উঠে আসছে তাকে খোঁজো, তাকেও সমর্পণ করো। তবেই হবে পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
রমণ মহর্ষিকে নিয়ে কোনো সম্প্রদায় তৈরি হয়নি। কোনো বিশেষ মত তৈরি হয়নি। কোনো গুরুবাদ তৈরি হয়নি। রামকৃষ্ণ মিশনের অনেক বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী মহর্ষির আশ্রমে কাটিয়েছেন, যাদের মধ্যে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর নাম উল্লেখযোগ্য।
আজকে এক নতুন গুরুবাদ। সেখানে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, সঙ্কীর্ণ রাজনীতি ছায়ায় মত ঘোরে। কেউ নিশ্চয় ভাবতেই পারেন না মহর্ষির সঙ্গে দেখা করতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে, বা রামকৃষ্ণদেব জনসভা করছেন। সেখানে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতালোভী মানুষগুলো কল্কে পেত না। হুড়কো দিয়ে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। অন্তরে সম্পদ পেলে তবেই যে না বাইরের সম্পদকে তুচ্ছ করার ক্ষমতা মেলে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ফলের ভারে আনত বৃক্ষের নত হওয়া দৈন্যের বশে না, আত্মলাভের বশে। আজকের গুরুরা বড় বেশি ভুল জায়গায় থেকে থেকে নত হয়ে পড়ছেন। অন্যের উপলব্ধির মার্কেটিং করে কি আর নিজের উপলব্ধির পথ খোলা যায়? আজ শুনি গীতা, উপনিষদেরও ক্লাস হয়। আমি ওরকম বেশ কিছু ক্লাস করে দেখেছি। ওতে শুধু “আমি গীতা জানি। আমি উপনিষদ জানি।” এর বেশি বোধ কিছু হয় না। কারণ ও বস্তু ক্লাসের বস্তু না। ভাবের বস্তু। এও সেই পাশ্চাত্যের অনুকরণ। যা অনুভব করার, তাকে বুদ্ধি-যুক্তির ছাঁকনিতে ছেঁকে, নেড়ে ঘেঁটে যা পাওয়া যায়, তা ঘোল। নিজের মধ্যে নিজেকে শান্ত করতে কত বই পড়তে হয়? জানি না। বুদ্ধিবিলাস বা অধ্যাত্মিক ডিজনিল্যাণ্ডের ছড়াছড়ি আজ চারদিকে। চারপাশে বেশ একটা শান্ত শান্ত ভাব। ধূপের গন্ধ, গাম্ভীর্য ইত্যাদিতে বেশ একটা ঘন মাখোমাখো পরিবেশ। কিন্তু আদতে সবটাই ফাঁকি। যা চিত্তের বস্তু, তাকে শুধু চরিত্রে পাওয়া যায়। তাকে না লেকচারে, না কূটব্যাখ্যায়, না গেরুয়ায়, না সুরে, না তীক্ষ্ণ লেখনীতে পাওয়া যায়। সে শুধু বিনোদন। উচ্চস্তরের বিনোদন।
কিন্তু ভারতের সত্যিকারের গুরুতত্ত্বে আপাত মধু যতটা না ছিল, তার চাইতে বেশি ছিল কঠোর শাসন, অনুশীলন। কিন্তু সে পথে চলে তো আর অধ্যাত্মিক ডিজনিল্যান্ড বানানো যায় না, শিষ্য পালাবে যে, তাই চারদিকে কেবল ফাঁকি আর ফাঁকি। গুরুও ফাঁকি দিচ্ছেন মধু মাখিয়ে, শিষ্যও ফাঁকি নিয়ে আসছে পরমানন্দে। আর আজ তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজনীতির সার্কাস। ব্যস, আর কি চাই! তবে খাঁটি বস্তু কই?... আসলে স্বাদের খিদে আর খিদের খিদে'র মধ্যে যে পার্থক্য আছে। আমাদের ভোজবাড়ির ব্যবস্থা রসনার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে। আর কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থা খিদের নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। কাঙাল হতে না পারলে কি আর সত্যিকারের মহাজনের দেখা মেলে?
“আপনাতে আপনি থেকো মন... তুমি যেও না কো কারো ঘরে,... যা চাবি তা বসে পাবি... শুধু খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে”...
(আগামী বুধবার, ৩০শে ডিসেম্বর ওনার জন্মদিন)