Skip to main content

পথ নিয়ে দুটো কথা বলেছেন, এক, মত পথ বই আর কিছু নয়। দুই, শালাগুলো সারাদিন পথের কথা নিয়েই কাটায়, ডুব কেউ দেয় না।

       কথা দুটো রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহাশয়ের। যিনি একটি মহৎ ভুল করেছিলেন, মতকে পথ বলে। যত মত তত পথ – বলে যে স্লোগানটা ওনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল।

       রামকৃষ্ণদেব ভুল করেছেন? হ্যাঁ করেছেন। তিনি জানতেন মত মানে পথ। পথ কার লাগে? উনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন পথ লাগে পথিকের বা যে চলতে চায় তার জন্যেই লাগে পথ। কিন্তু পথের দুই ধারে যে ব্যবসা করা যায় সেকি উনি জানতেন? না জানতেন না। কারণ? কারণ উনি বলে না, যে কোনো অমন ধরণের মানুষ জন্মেছেন, তাঁরা কেউই ধারণা করতে পারতেন না মানুষ এতটা ত্যাঁদড় প্রকৃতিরও হতে পারে।

       আদতে সত্যিই কি আমরা পথ চাই? মনে হয় কেউ চাই না। আমরা সেই পথের ধারে দোকান ঘর কিনতে চাই। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বড় বড় দোকান ফেঁদে সেইখানে বড় বড় হোটেল খুলে ফেলেছেন। সেখানে কি নেই? সমস্ত রকম স্পিরিচুয়াল বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। সেখানে সেলামি দিলে আপনিও ছোটো দোকান খুলতে পারেন আশেপাশে। কিম্বা তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে আপনি অন্যত্রও ব্যবসা খুলে বসতে পারেন। কিন্তু পথ দিয়ে এগোতে চাইবেন না, ওইতেই যত গোল। একটা ক্ষুদ্র নাটিকা ভাবা যাক--

       ধরুন কেউ অমনধারা পুরুষ সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, যেই না তার নামের হোটেলটা সে পার হচ্ছে অমনি কেউ এসে রাস্তা আটকে বলল, কি মশায়, কই চললেন? আরে এদিকে আসুন, আপনার পাথরের ইয়াব্বড় মূর্তি বানিয়েছি তবে কিসের জন্য? তাকে গৃহবন্দীই করেছি কি শুধু? সাজাইনি কি নানা ফুলে? আসুন দেখে যান। অকারণে চলে ফিরে বেড়াবেন যদি তবে এত দামী মার্বেল দিয়ে এতবড় হোটেল বানাতে গেলুম কেন?

       সে মানুষ যদি বলে, উঁহু, বসার কথা তো আমি বলিনি! আমি বলেছি চরৈবেতি, চরৈবেতি। মানে এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। অমনি হোটেলের প্রধান এসে বললেন, আহা সে ব্যবস্থাও আছে, দেখবেন চলুন।

       উনি আবার বিশ্বাস করে হোটেলে ঢুকলেন। গিয়ে দেখেন, ওমা! একটা বড় গোল করা, তাতে নানা মানুষ সেই গোলের পরিধি বরাবর ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। উনি থমকে বললেন, একি চলা? এতো ঘুরেই যাচ্ছে, একটা জায়গায় পাক খাচ্ছে!

       হোটেলের মালিক বলল, সেই তো চাই, চলা নিয়ে কথা, ওরাও জানে ওরা একটা খেলা চাইছে, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইছে, যাতে এই কঠিন, নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন সংসারে কিছু একটা নিয়ে ভুলে থাকতে পারে। তবে বলুন, ঠিক করিনি? এতে অন্তত ওরা কিছু একটা নিয়ে তো থাকছে, হ্যাঁ কি না?

       কিন্তু এতো অন্ধকূপ? আলো কই? এত ঘুরে তো অবশেষে যেই মানুষ সেই মানুষই থাকবে, এতে কি হবে?

       ভুল বললেন। মোটেও একই মানুষ থাকবে না। ওরা গোঁড়া হবে আরো। যত গোঁড়া হবে তত কথায় জোর আসবে, তত আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তত অন্যকে ভুল জেনে নিজেকেই একমাত্র ঠিক বলে জানবে, যুক্তির কথা শুনবে না, শুধুমাত্র ওই বইটার কথা শুনবে।

       কোন বই?

       কেন আপনার কথা নিয়ে যে বইটা লেখা হয়েছিল, সেই বই। ওদের বলে দিয়েছি উনি যা বলে গেছেন তাইতেই সব সত্যি আছে...

       মানে আমার মৃত্যুর পর থেকে সত্যের প্রকাশ হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, এই বুঝিয়েছ ওদের? হা কপাল! কিন্তু এতে তো ওদের বোধবুদ্ধি লোপ পাবে!

       পাক, তাতেই ওরা শান্তি পায়, ওরা বলে আমাদের এমন কিছু একটা দিন যাতে আমরা সংসারের সব জ্বালা ভুলতে পারি। আর কিছু না। আমাদের আর কিচ্ছু চাই না....... আমরা ওদের এই ধর্ম ধর্ম আধ্যাত্মিক খেলা দিয়ে দিই, একটা বই, একটা মূর্তি আর কয়েকটা শব্দমালা... ব্যস, ওরা ঘুরে ঘুরে খেলে, খেলে খেলে ঘোরে। ওরাও শান্তি পায় আর আমরাও ট্যাক্স পাই।

       কিসের ট্যাক্স?

       কেন? এই খেলাটা শেখানোর ট্যাক্স!

       কিন্তু তোমরা ওদের বলো না যে সত্যতে থাকলে, কাউকে হিংসা না করলেই মানুষের চূড়ান্ত মঙ্গল...

       হো হো... এসব কথা বললে মশায় আপনার মত হাল হত আমাদের... মাত্র বছরে দু'সেট জামা, গাড়ি বাড়ি নেই, কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, কোনো সুখ-বিলাস নেই। ওই চৌকিতে শুয়ে কুঁজোয় গড়িয়ে জল খেয়ে সারাদিন ঈশ্বর চিন্তা করে, এর তার সাথে বকে বকে জীবনটা ব্যর্থ হত আমাদের!

       কিন্তু তোমাদের ওরা বিশ্বাস করে কেন?

       করবে নাই বা কেন? প্রথমত আপনাকে আমরা সামনে রাখি.....

       আমাকে না, আমার মূর্তিকে...

       ওই হল, ওদের কাছে আপনার চাইতে ওই মূর্তি-ছবিই ভালো, নইলে আবার কাকে চড় মারবেন, কাকে চুলের মুঠি ধরে বার করবেন, কাকে বাঁশ নিয়ে তাড়া করবেন, কার দোকানপত্র ভাঙবেন... তার চাইতে ছবিতে মূর্তিতে চুপ করে বসে থাকেন, আমরা যা ইচ্ছা করে যাই। এই ভালো নয় কি?

       আমার মাথা ঘুরছে...

       সে ঘুরবেই... যা বলছিলাম... ওদের আমরা বুঝিয়েছি... আমরা যা করি তা মনের মধ্যে অনাসক্তভাব থেকেই করি, বাইরের এই সবই মায়া... এতে আমাদের কিছু মন নেই...

       আমাদের নাটিকাটি এখানেই শেষ হল। এইবার ভাবুন, কেন রামকৃষ্ণদেব আসার পরেও এত ধর্মে ধর্মে দলাদলি, বা এই এত বাহ্যিক আড়ম্বরের বাড়বাড়ন্ত। কারণ উনি একটা মস্ত ভুল করেছিলেন। পথ বলেছিলেন। কেউ পথ চায় না। কারণ কারোর কোথাতেও যাওয়ার নেই। সবাই একটু জিরোতে চায়। বিশ্রাম চায়। সারাদিন খাটাখাটনির পর এসে ভালো কয়েকটা কথা শুনে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। তাই কয়েকটা ভালো কথা বলতে পারা লোকের কাছে এত মানুষের ভিড়। কিন্তু যেই কঠিন কথা, বা কাজের কথা বলবে, অমনি বন্ধু বিগড়ে যাবে। পথ চাই না আমাদের, আমাদের হোটেল দাও। এই হল গিয়ে কথা।

       এখন আপনি যদি পথকে সরিয়ে হোটেল রাখেন। দেখবেন হিসাব সোজা। কম্পিটিশানের ভাবটা চলে এলো। লাভ-ক্ষতি ভাবটা চলে এলো। মাঝে মাঝে ফিল্যানথ্রপিক কাজ করার ভাবটা চলে এলো। দলাদলি, কপটতা, বিজ্ঞাপন, আত্মজ্ঞাপন - ইত্যাদি কোনো শব্দতেই আর আপনার অসুবিধা হচ্ছে না (মানে যদি আপনি যুক্তিবুদ্ধির মানুষ হন), সব শব্দ চেনা এখন। জানা। কারণ মূল কথাটা বদলে নিয়েছেন, পথ না, পথের ধারে হোটেল।