বহুদিন আগে কোনো এক নিকটাত্মীয়া আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর সন্তানকে তিনি কোন মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেবেন? বাংলা না ইংরাজী। উত্তর দিয়েছিলাম, ইংরাজী। তখন আমার দৃঢ় ধারণা ছিল ইংরাজী ভাষায় ভিত্ খুব মজবুত না হলে পেশাগত জীবনে পিছিয়ে পড়তে হবে। কেরিয়ার ছাড়া যে জীবনের অনেকাংশ বাকি পড়ে থাকে, সে বোধ তখনও জন্মায়নি বোধহয়, বা গুরুত্ব পায়নি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, আত্মীয়া আমার সে পরামর্শ কোনো কারণবশতঃ বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হননি। যদি হতেন, তা হলে আজ আমার আত্মগ্লানির সীমা পরিসীমা থাকত না।
আজ অনেকটা পথ হেঁটে বুঝেছি, জীবনটা তালগাছের মত একবগ্গা, একমুখী না। তার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, অনেক ফুল-ফল-পাতা। অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না জানি, জেনেও বলছি, প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় না দেওয়া, শিশুটির সাথে অপরাধের সামিল। তাকে মাটি থেকে তুলে, টবের কৃত্রিম পরিবেশে, কৃত্রিম পরিচর্য্যায় রাখার মত ভাল করতে যাওয়া। তাতে হয় তো সে খুব চলনসই, কাজের বস্তু হয়ে ওঠে, কিন্তু তার অন্তর্জীবনে সে থেকে যায় নির্বাসিত, বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণ।
মানুষ জন্মসূত্রে প্রাকৃতিক ভাবে যেমন মাটি, দেশ, জলবায়ু, সংস্কৃতি, মা- বাবা পায়, তেমন একটা ভাষাও পায়। সে ভাষা তার প্রাণের ভাষা, বিশ্ব সংসারের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার তার নিবিড়তম যোগসূত্র। তাকে ছিন্ন করার অর্থ, মাতৃগর্ভে ভ্রূণকে ছিন্ন করে আরো উন্নত কৃত্রিম পুষ্টিতে বড় করার চেষ্টা। তাতে প্রয়োগক্ষম হয়ে ওঠলেও, স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে বসে।
মানুষকে সবশেষে নিজের স্বভাবের কাছে ফিরে আসতে হয়। সে স্বভাব শুধু আভ্যন্তরীণ না। আমি যে দেশে, যে পরিবেশে, যে সময়ে, ভাষাতে জন্মেছি, সে সব মিলিয়ে তার স্ব-ভাব, তার স্ব-স্থান, তার স্ব-পরিচয়। তা গ্রহণ করার জন্য কোনো অতিরিক্ত চেষ্টা করতে হয় না। সে ইতিমধ্যেই আমার সত্তার সাথে অনুস্যূত। আমার সময়, ভাষা, পরিবেশ আমার আত্মবিকাশের সব চাইতে সহজ উপকরণ, কারণ সে আমার জন্মপ্রাপ্ত অধিকার।
যখন দেখি, কোনো মানুষকে নিজের মাতৃভাষার সাথে বেশি বয়সে চেষ্টা করে যুক্ত হতে হচ্ছে, খুব করুণ যন্ত্রণা অনুভব করি তার ছিন্নমূল পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে। কোন শুভাকাঙ্ক্ষী তার শিশু বয়সে তাকে তার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিকাশ ব্যহত করে ব্যতিক্রমী বনসাই বানাতে গিয়েছিলেন কে জানে!
আজ সেরকম বনসাই চারদিকে। ইতঃনষ্ট ততঃভ্রষ্ট বলে একটা কথা আছে, তার উদাহরণে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। একটা কথা ভুললে কিছুতেই চলবে না, আমি আমাকে একমাত্র আমার ভাষাতেই পেতে পারি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। তাঁরা স্বতন্ত্র। মধুসূদন দত্ত সকলে না।
একদল বলবেন, "আমি তো বাংলাটা ছোটবেলা থেকে জানতামই না, পরে শিখে বেশ রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল গাঙ্গুলী পড়ে ফেলছি"। এটা কোনো কাজের কথা না। কথা হচ্ছে একটা সংস্কৃতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে যে আপনি কি হারাচ্ছেন, আপনাকে বোঝাই কি করে!
পরিশেষে বলি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে মানগত ও গুণগত দিক। এটা আছে অস্বীকার করি না। কিছু বেসরকারি বিদ্যালয় ছাড়া, প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে ভাববার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি বেশ কিছু প্রাথমিক বেসরকারি বিদ্যালয় বাংলা ভাষায় যে ভাবে শিক্ষার পথ তৈরী করেছেন, তাও প্রশংসার দাবী রাখে। অনেক আগে দেশ পত্রিকায় একটা কথা পড়েছিলাম, 'বাংলা ভাষা মাতৃদুগ্ধ, ইংরাজী বেবিফুড'।
কথাটা খাঁটি। সেই মায়ের কাছেই আলোর প্রথম পথ তৈরী হোক, বাকিটা হাঁটার পথ সেই আলোই দেবে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
23 August 2015