Skip to main content

 

অপমান অনেক সময়েই যোগ্য অযোগ্য বিচার করে না। যদিও বিশুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানে কেউ-ই অপমানের যোগ্য নয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে অমন বিশুদ্ধভাব আচরণে পাওয়া কঠিন।

এক সময়ে আমি মাঝে মাঝে এক অভূতপূর্ব চরিত্রের মানুষের কাছে গিয়ে বসতাম। তিনি বৈষ্ণব সন্ন্যাসী। বয়েস প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। অমন নির্লোভ, পণ্ডিত, রসজ্ঞ, নিরভিমানী মানুষ সত্যিই বিরল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা লাভের সুযোগ হয়েছিল। তিনি এ মরজগতে নেই বহুকাল হল। কিন্তু তাঁর স্মৃতি বহু কঠিন সময়ে আমাকে শান্ত রাখে।

আমি ওঁকে অপমানিত হতে দেখেছি বহুবার। ওঁরই সন্ন্যাসী সেবক শিষ্যের কাছেই। কারণ কী? সেই শিষ্যের মতে, “যদি এনার বুদ্ধি থাকত, তবে এই ছোটো আশ্রমে না থেকে বিরাট আশ্রম উনি করতে পারতেন। অমুক তমুক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কত বড় বড় আশ্রম বানিয়েছে, সেখানে কত সুযোগ সুবিধা, আর ইনি এত পণ্ডিত, এত এত জ্ঞানীগুণী ধনী মানুষ আসে এনার কাছে, অথচ উনি…”

এইসব কথা সেই সেবক-শিষ্য সেবা করতে করতেও বলে যাচ্ছে বহুবার শুনেছি। তিরস্কারের পর তিরস্কার করে চলেছে। আর গুরু যিনি তিনি হয় তো কয়েকটা মৃদু প্রতিবাদ করে চুপ করে গেলেন।

পরে যখন জিজ্ঞাসা করেছি, সহ্য করেন কেন?

উনি বলছেন, আমি যদি সহ্য না করি, ও যাবে কোথায়?

এরকম আরো নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে আমি দেখেছি ওই ক্ষুদ্র সন্ন্যাসীর কী দাপট! মানুষটার বয়েস, চরিত্রের মহত্ব, শুদ্ধতা কিছুই ওকে স্পর্শ করত না।

আরেক দিনের ঘটনা। একদিন সন্ধ্যে হব হব কিছু নিত্য কাজে সে সন্ন্যাসীর কোনো দেখা নেই। আমাকে ইনি বললেন, তুমি একবার দেখবে গিয়ে, ও ঘুমিয়ে পড়ল কিনা….

আমি জানি আমি হঠাৎ তার ঘরে গিয়ে পৌঁছালে সে ভালোভাবে নেবে না। ইতস্তত করেও গেলাম। যথারীতি সে ঘুমাচ্ছে। ডাকলাম। সে, মুহূর্তের অপদস্থ ভাবটা কাটিয়েই গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি গৃহী মানুষ, ভোগী, আপনি আমাদের কঠোর জীবন সম্বন্ধে কী জানবেন? ভাবছেন আমি অলস…খাইদাই আর বেশ থাকি…কটায় উঠে জপে বসি জানেন…..

আমি কিছু বলার সাহস দেখালাম না। মানুষের চরিত্র নিয়ে অভিজ্ঞতা কম নেই। বাইরের মানুষ আর ভিতরের মানুষের দ্বন্দ্ব যেখানে যত বেশি জটিলতাও সেখানে তত বেশি। আমি নম্র কণ্ঠে বললাম, আজ্ঞে, আপনাকে উনি ডাকছেন।

যান যান…. বলুন গিয়ে আমি আসছি…..

আমি আবার বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পাশে এসে বসলাম। বললাম, আসছেন।

মিনিট চারেক পর এসেই সে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তারপর দুটো নয়নতারা ফুল পায়ে দিল। একটা ঘটি থেকে এক আঁজলা জল দিয়ে পা ধুয়ে দিল। তারপর গামছা দিয়ে মোছাতে মোছাতে বলল, যা সব লোক আশ্রমে যাতায়াত করতে দিচ্ছেন এ আশ্রমের শুদ্ধতা কদ্দিন থাকবে বলতে পারি না….গৃহীদের সব যায়গায় যাওয়া….

বৃদ্ধ মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন, কিন্তু ও তো অবিবাহিত….

সে যাই হোন গৃহীই তো।

ওদিকে মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠল। শ্রীরাধাগোবিন্দের আরতি হবে। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী উঠতে পারেন না। তিনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকেই দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। সেবক গেলেন মন্দিরের দিকে। আমি উঠলাম না। একবার শ্রীবিগ্রহ প্রণাম করে ওঁর কাছে বসলাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে রাতের দিকে যাচ্ছে। আমি অপমানের অনেক রূপ দেখেছি। আজও দেখলাম। অপমান অবহেলার জন্য অনেক মানুষ যোগ্য নন। তবু হন।

কিন্তু কেন?

এর উত্তর কে দেবে? যা আছে তাই আছে। যা ঘটছে তা-ই ঘটছে। যা নেই তা কেন নেই, যা ঘটল তা অনুচিত হতেও কেন ঘটল, এর উত্তর কে দেবে? এই উচিত আর অনুচিতের হিসাব কার কাছে মিলিয়ে নেব?

উত্তর নেই। সান্ত্বনা আছে। কোনো মহৎ প্রাণের সান্নিধ্যে যে সান্ত্বনা সে কোনো বই পড়ে, হাজার হাজার যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে পাওয়া যায় না। রুমি বলছেন একজন মরমী বই খোঁজে না, মরমী খোঁজে। মরমীই পারে সব বিষ সংসারের কণ্ঠে ধরে রাখতে, অমৃত বচন বলতে। অথচ সে বচন কন্ঠে ধরা বিষে বিষাক্ত হয় না। কেন হয় না? জানব কী করে? সে মহত্বে আমার অধিকার কই?