আন্তরিক হলে হবেই হবে।
দক্ষিণেশ্বরের সকাল। কুয়াশা কুয়াশা গঙ্গা। ওপার দেখা যাচ্ছে না। একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। আন্তরিকতায় ভর করে দাঁড়িয়ে। কোনো কৌশল না। কোনো গুপ্ত তন্ত্রমন্ত্র না। কোনো দল সম্প্রদায় না। বলছেন, আন্তরিক হও, সব ভুল শুধরে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
উপায় কি? এ জীবন বড় জটিল। যা ভাবি, যেমন ভাবে হবে ভাবি, কিছুই হয় না। কোনোদিকে দিশা পাই না। আমিও বদলে যাচ্ছি। আমার চারপাশও বদলে যাচ্ছে। কি হবে? উপায় কি?
উত্তর, আন্তরিক হও।
আন্তরিক হতে গেলে অন্তরকে দেখতে হয়, জানতে হয়। আমার রাগ-হিংসা-ঈর্ষা-অভিমান আন্তরিক। আমার অভিশাপ আন্তরিক। কিন্তু আমার ভালোবাসা? আমার সহ্যক্ষমতা? আন্তরিক কি? মতলবী মানুষ কি আন্তরিক হয় ঠাকুর? আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মতলব। আমি কি চাইলেই আন্তরিক হতে পারি?
নিজেকে একটু আলগা দাও। মাকে দেখো। এত বড় সংসার। তোমাদের মত শিক্ষিত মানুষের ঢল। গ্রামের ওই পড়াশোনা না জানা, তোমাদের মত শহুরে আদবকায়দা না জানা মানুষের ঢল। সব সামলে দিচ্ছেন। কি করে? কি মন্ত্রের জোরে? ওই আন্তরিকতা। আন্তরিক, কিন্তু আসক্ত নয়।
নহবতে মা আছেন। এই একটা শব্দেই সব বলা হয়ে গেল। মা আছেন। বলছেন, কায়দায় ফেলে মানুষকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।
কিন্তু মানুষকে ব্যবহার করেই তো আমাদের জগত। আরো ভালো করে বললে অপব্যবহার করে। ঠকিয়েই আমার লাভ। আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে এই বুঝেছি। সৎ হতে গেলে সব ঠকিয়ে যায়। বিপদে পড়তে হয়।
তাই কি?
জানি আমার এ ভ্রান্তি। লাভের পথ আর শান্তির পথ আলাদা। লাভের নেশায় নীতি-দুর্নীতির খেয়াল থাকে না। কিন্তু শান্তি আন্তরিক না হলে পাওয়া যায় না। জানি। কিন্তু সাহস নেই। আন্তরিক হওয়ার সাহস নেই। তাই আনুষ্ঠানিক হই। যেখানে আন্তরিকতা যত কম আনুষ্ঠানিকতা তত বেশি। আমার গোটা জীবন আনুষ্ঠানিক। আমার স্বপ্নও আর আগের মত অকৃত্রিম নয়। স্বপ্নও লোভী। স্বপ্নও মতলবী।
স্বামীজি জানেন। “যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিও নিশ্চয়…… লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর মুরতি তাকি সয়?... হৃদিবান নিঃস্বার্থ প্রেমিক… এ জগতে নাহি তব স্থান। হও জড় প্রায়। অতি নীচ। মুখে মধু। অন্তরে গরল। তবে পাবে এ সংসারে স্থান।”
স্বামীজি জানতেন। আন্তরিক হলে জীবন দুঃসহ হয়ে যাবে। মানুষ ঠকিয়ে যাবে। আঘাত করে যাবে। অন্তরকে যদি দাও, ক্ষতবিক্ষত করে যাবে। তবে আর আন্তরিক কেন হব? তার চাইতে হিসাবি হই। মেপে পা ফেলি। মেপে কথা বলি। দাবার চালের মত গোটা জগতকে দেখি। কিন্তু দাবার শেষে তো শুধুই হারজিৎ। জীবন কি শুধুই হারজিৎ? তাতে ভরে উঠবে জীবন? লাভের অঙ্ক ভরবে। জীবন না।
কুয়াশা কাটছে। ওপার স্পষ্ট হচ্ছে। রোদ উঠছে। শূন্য গঙ্গাতীর। কেউ নেই। হিমালয় গলা জল সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করছে, শুধুই কি জাল ফেলে বসে থাকবে? ভাসবে না? যাবে না সাঁতরে মোহনার দিকে? নাকি সময় ফুরালে জড়ের মত ভেসে থাকবে জোয়ারভাটায়।
কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না।
জল বলল, সব জানো। জলে নামো। আন্তরিক হও। হাতে পায়ে জাগবে ছন্দ। সাঁতরে যাবে। আঘাত পাবে। ঝড় পাবে। ঘূর্ণি পাবে। কিন্তু ডুববে না। শুধু আন্তরিক মোহনার দিকে এগোবে চলো। নিজের জালে নিজেই আটকে বসে থেকো না। সময়ের জালে বাঁধা পড়বে যে!!
ওপারে কুয়াশা কাটা আলোয় দাঁড়িয়ে কে? আকাশে বাতাসে ঠাট্টার সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ছে..... শেষে কি দৃষ্টিকানা, কানে কানা হলি? অনুভব মেলে দাঁড়া। মস্তিষ্ক যা পারে না, হৃদয় পারে। "ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ। কৃপাপাত্র হয়ে কি বা ফল। দাও। আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল। অনন্তের তুমি অধিকারী। প্রেম সিন্ধু হৃদে বিদ্যমান। দাও দাও - যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু, বিন্দু হয়ে যান।"
সিন্ধুতে সাঁতার দিতে চাস, না বিন্দু ঘিরে হতাশ্বাস রে?