সৌরভ ভট্টাচার্য
25 April 2018
“Ceasing to believe caused a permanent scar in the place where one’s faith had been, making it impossible to forget.”
~ Gabriel Garcia Marquez
সিদ্ধান্ত নেওয়া কয়েকটা শর্তের ওপর নির্ভর করে --- ১। তার জানা; ২। তার প্রবণতা; ৩। কোন বাহ্যিক প্রভাব।
১। জানা
-------------
যখন আমরা কিছু জানি তা বৌদ্ধিক স্তরে দুটো পথে আসতে পারে --- ১। অভিজ্ঞতা এবং ২। পাঠনির্ভর। বৌদ্ধিক স্তরে কল্পনাশক্তি মানুষকে পাঠনির্ভর বিচার-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম করে। যখন কোন উপন্যাস পড়া হচ্ছে, যার প্রেক্ষাপট আমার অভিজ্ঞতার বাইরে কোন সময় ও দেশকে নিয়ে, আমার কল্পনাশক্তি সে প্রেক্ষাপটকে আমার গ্রহণক্ষমতার কাছে বাস্তব করে তোলে। পঠিত চরিত্র, স্থান আমার আশেপাশের ইন্দ্রিয়লব্ধ দুনিয়ার সাথে এক হতে শুরু করে।
আরো সুক্ষ্মদিক থেকে দেখলে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার তাত্ত্বিক প্রতিফলনও পরিবর্তিত হয় আমার পঠিত কোন তাত্ত্বিক বিচারের মাধ্যমে। এরা যুগপৎ আমার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ আমি আমার অভিজ্ঞতায় জানি, কোনো প্রতিকুল পরিবেশে হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে কিছু ক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়। অথচ আমি পাঠের মাধ্যমে জানলাম, ক্ষমা ও সহনশীলতা অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে অধিক ফলপ্রসূ এবং সদর্থে ফলপ্রসূ। পরেরবার যখন কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লাম তখন আমার পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ সিদ্ধান্ত হিংসাত্মক হয়ে ওঠা ও পাঠজনিত বিচারশীল সিদ্ধান্ত, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা - এদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, যার ফলস্বরূপ আমার হিংস্রতার প্রাবল্য কিছুটা কমে খানিক বেশি সভ্য হয়ে উঠি, যেভাবে সভ্যতার বিকাশ হয়। তা যতটা না সহজাত প্রবৃত্তিজনিত জান্তব আবেগের তাগিদে, তার থেকে অধিক বলবৎ সভ্যতার ইতিহাসের ক্রমান্বয়ে আসা নানা শুভবিচারসম্পন্ন মানুষের সৎচরিত্র ও সৎ-শুভ বিচারলব্ধ নির্দেশনার পঠনের প্রভাব। দমন, সংযম, অনুশীলন ইত্যাদি শব্দগুলোর মাহাত্ম্য ক্ষণিক জান্তব আবেগের কাছে অর্থহীন হলেও একটা স্থায়ী সভ্যতার দিকে তাকিয়ে এগুলিই সম্বল, যাকে শীল তথা Discipline নামে অভিহিত করা হয়।
২। প্রবণতা
----------------
কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রবণতার প্রভাব ততটাই, যতটা কোনো যানে তার গতিক্রিয়তা। প্রবণতাকে সুসংহত ও সুশীল করার প্রাচীন পদ্ধতিকে আমরা একসময় শিক্ষা বলেছিলাম। যদিও আজ শিক্ষার অর্থ কুশলী হওয়া --- তথ্যে অথবা কৌশলে। সে অন্য প্রসঙ্গ। প্রবণতাকে সুসংহত করার কথা ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে যাদের মাধ্যমে এসেছে তা হল শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য। ধর্মের যেদিকে সঙ্গীত ও শিল্প এসেছে তা নম্র ও কোমল। এর বিপরীতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সেখানে ডাইনী হত্যা থেকে সতীদাহ --- সবই এক ছাতার তলায় ঠাঁই পেয়ে যায়, এমনকি কখনও কখনও কুসংস্কার এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, সে সঙ্গীত শিল্প সাহিত্যকেও ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ বলতে পিছপা হয় না। সভ্যতা বর্বরতার প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে কিছুকালের জন্য পশ্চাদ্গমনে উন্মুখ হয়। তবু অবশেষে শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীতই মানবাত্মার আত্মপ্রকাশের ভগীরথ হয়, কারণ এই তিনটির কেন্দ্রই মানবিকতা তথা সহমর্মিতা। একটা ভোরের ফুলের মাধুর্য্যমণ্ডিত কোমলতা যে হৃদয় উদ্ভাসিত হয় সেই হৃদয়ই শিল্পী নামের যোগ্য। দুর্বলতম মানুষটার সবলতম মানুষটার হাতে নির্মম অত্যাচার যে হৃদয়ে বিনিদ্র কশাঘাত করে সে হৃদয়ই সাহিত্যিক হওয়ার যোগ্য। আর সীমায়িত জীবনের অসীম প্রেমের আত্মপ্রকাশের যে আকুতি সে-ই যখন মহাকাশ ব্যেপে সুরে কোনো হৃদয়ে প্রতিদ্ধনিত হয় সে হৃদয়ই সঙ্গীতের।
মানুষের সমস্ত জান্তব প্রবণতা শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত দ্বারা যদিও নিয়ন্ত্রিত হয় না, তার জন্য লাগে যৌক্তিক অনুশাসন, যাকে অন্য অর্থে আমরা বলিCivic Code, যা অবশ্যই মানুষের হৃদয়ে শুভবুদ্ধির সমর্থন ও করুণাসঞ্জাত। তাই সেদিনের কারাগার আজকের সংশোধনাগার হয়ে ওঠে। আমরা সংশোধনে বিশ্বাসী হই। তবুও বর্বরতার কাছে আজও মানুষের শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ জয়ী হয়ে উঠতে পারেনি। শুভেচ্ছা এখোনো বহুরাত নির্মম নিদারুন নিষ্ঠুরতায় অসহায়ের মতন মাথাকুটে মরে। মানবসভ্যতার গ্লানি আজও সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি।
৩। বাহ্যিক প্রভাব
-------------------
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবচাইতে বিপজ্জনক প্রভাবক এটি, যার মুখ্যস্থানে রাজনীতি ও ধর্ম ক্ষুদ্র নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্ধতাদুষ্ট। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য সে সবই সীমায়িত ও পরিশীলিত অনুভব ও বোধের ক্ষেত্রে। যার সার্থকতার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ হল শ্রী তথা সামঞ্জস্য। মানবসভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস থেকে আজ অবধি যা তার উদারতাকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তা হল উদারতার ছদ্মবেশে আসা ধর্ম। সভ্যতার এর থেকে বড় পরিহাস আর কি হতে পারে? মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তি-উদারতা-আত্মবিকাশের প্রতিশ্রুতি দেয় যে ঈশ্বর এবং স্বঘোষিত প্রেরিত পুরুষকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানেরা, দুর্ভাগ্য, সময়ের আয়নায় দেখলে মানুষের মুক্তি, উদারতা ও আত্মবিকাশের সবচাইতে নিষ্ঠুর এবং বলশালী অন্ধকার ইতিহাসে রচয়িতা হয়েছে তারাই। শত্রু যখন মিত্রের ছদ্মবেশে আসে তখন তা ভয়ঙ্কর। তাই রাবণের চেয়ে ভয়ঙ্কর শকুনি। কুরুক্ষেত্রের চেয়ে ভয়ঙ্কর ধৃতরাষ্ট্র ও নানা শূরবীর সাক্ষী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। এটা চিরকালই হয়েছে, আজও হয়ে চলেছে। কারণ, যতদিন মানুষ মুক্তিকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টার মাধ্যমে না চাইবে, উদারতাকে উদারতা লাভের প্রচেষ্টার মাধ্যমে না চাইবে তথা আত্মবিকাশকে বিপদসংকুল নানা জান্তব প্রবণতার মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে সামনের দিকে এগোতে না চাইবে ততদিন আমাদের ঈশ্বর তথা ধর্ম নামক রূপক মুক্তি-উদারতা-আত্মবিকাশের মোহে আত্মপ্রবঞ্চনায় স্থবির হয়ে থাকতে হবে। সেদিনের মায়ের দয়া আজ বসন্ত রোগ। Small Pox, Polio প্রায় নির্মূল জগত থেকে। সেদিনে কুকুরে কামড়ালে খ্রীষ্টান যাজকরা শয়তানের ভর মনে করে কত শিশুকে হত্যা করেছে, চিকিৎসার অভাবে বিষপান করিয়ে মেরেছে, মানসিক ভারসাম্যহীন বহু চরিত্র ডাইনী আখ্যা পেয়ে পুড়ে মরেছে। এ সবই ছিল ধর্মের সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত, সর্বোপরি সমাজের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কৃত ঈশ্বরেচ্ছার বাস্তবিকরন। সেদিনও ঈশ্বর নীরব ছিলেন, তিনি আজও নীরব থাকেন। মানুষ যেখানে পাশের মানুষটার ইচ্ছে সম্পূর্ণ অর্থে বুঝে উঠতে পারে না, সেখানে কিছু মানুষ দাবী করেন তারা না কি জগতকেন্দ্রের শাসক পুরুষের ইচ্ছার শারীরিক স্বরযন্ত্রস্বরূপ।
নির্বোধ মানুষ সে ফাঁদে পা দেয়। কারণ, তার জানা, তার অভিজ্ঞতা, তার পাঠ ইত্যাদি সমস্তকে একত্র করলেও তার মধ্যে যে অন্ধকারটা বেঁচে থাকে তা অসীম। সে সবকিছু না জানলেও এটুকু জানে সে সবটুকু জানে না। সেখানে সে দুর্বল হয়, সে আতঙ্কিত হয়। সে যদিও জানে তা তার Small Pox ইত্যাদি বহু মারণরোগ কোনো ঐশ্বরিক, আকস্মিক, অলৌকিক হস্তক্ষেপে পৃথিবী থেকে নির্মূল হয় নি। নির্মূল হয়েছে কোন এক সত্যান্বেষী সাধকের বিনিদ্র গবেষণায়। প্রতিভার ব্যাখ্যা থাকে, কিন্তু অলৌকিকত্বের না তো থাকে ব্যাখ্যা, না পরিচয়। সে অলৌকিকত্বের অন্ধকার মানুষের পূর্বোল্লিখিত অজ্ঞানতার অন্ধকারের দোসর হয়ে ওঠে। নির্বোধ, অসহায় মানুষ আরেকজন কোন মানুষকে ঈশ্বর বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। আরেকটা অন্ধ অনুসরণের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। পেয়েও যায়। একটা অন্ধকার যুগের পরে আরেকটা অন্ধকার যুগ শুরু হয়। আশা এই তবু মানুষ আলোতেই বিশ্বাস রাখে। আলোতেই নির্ভয় হয়। সত্যি আলোটা এলে আলোর মত নকল আলোকে চিনতে তার সময় লাগে না। সভ্যতায় নতুন জোয়ার আসে।