বাঙালির ইষ্টচেতনা একটা জটিল প্রশ্ন। রামনবমী উপলক্ষ্যে দেখলাম বাংলা কাগজেও শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে লেখা হয়েছে। আগে লেখা হত হিন্দি কাগজগুলোতে। প্রেক্ষাপট অবশ্যই থাকত রামচরিতমানস।
একদিন বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় ‘কৃষ্ণচরিত্র’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। চেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ হোক কেন্দ্রীয় চরিত্র। বঙ্কিমবাবুর বাড়িতেও শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আগ্রহ ও চর্চা যে দীর্ঘদিনের সেটা প্রবন্ধটা পড়লেই অনুভব করা যায়।
যদিও বাঙালির অধ্যাত্মিক ইতিহাসের সব চাইতে বড় অধ্যায় বলে আমার মনে হয় শ্রীমহাপ্রভু। শ্রীমহাপ্রভু রাজদর্শনে যেতেন না। অনেকবার কাঙ্ক্ষিত হলেও চাননি। ইদানীং মহাপ্রভুকে একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে। তার উপাদান ইতিহাস ঘেঁটে নিজের মত ব্যাখ্যায় আনা হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প আছে, যার যেমন পুঁজি। একজন হীরে নিয়ে দরদাম করতে বেরিয়েছিল বাজারে। কেউ বলল দুই ঝুড়ি বেগুন দেব। কেউ বলল কয়েকটা গামছা দেব। এরকম আরকি। শেষে জহুরি বলল, আসল দামটার কথা। এখন মহাপ্রভুকে বুঝতে গেলে ওঁর কর্মকাণ্ডকে যেমন দেখা দরকার, তেমনই ওঁর যে শিক্ষা, চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত, তাছাড়াও রূপ সনাতনের লেখাগুলো যা আছে, সেগুলোও গভীরভাবে অধ্যয়নের দরকার। তবে বোঝা যাবে মহাপ্রভুর দ্বারা অনুষ্ঠিত কাজগুলোর প্রেরণা কী ছিল। নইলে আমাদের বুদ্ধিতে সেগুলোর বর্ণনা করতে গেলে আবার ওই শ্রীরামকৃষ্ণের গল্পের মত এক গোয়াল ঘোড়া হয়ে যাবে। হচ্ছেও।
মহাপ্রভুর শ্রীকৃষ্ণ চেতনা। শ্রীরামকৃষ্ণের জগদম্বা চেতনা। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে বৌদ্ধ আর বৈষ্ণব-রসের চেতনা। এই বাঙালির অধ্যাত্মিক চেতনার মূল তিন স্তম্ভ। বাকি অনেক ছোটো ছোটো রাজ্য আছে। তবে তার বেশিরভাগটাই মহাপ্রভু থেকে শুরু,একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে। কেন?
কারণ হল মহাপ্রভু যে স্বচ্ছতায় সাধনপথটাকে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করেছেন তেমন উদাহরণ বাংলায় আগে নেই। হিন্দুধর্মের তিনটে প্রধান স্তম্ভ। এক, শঙ্করাচার্য। দুই, রামানুজ। তিন, মধ্বাচার্য। অদ্বৈতবাদ। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। আর দ্বৈতবাদ। মহাপ্রভুর শিক্ষা দ্বিতীয় আর তৃতীয়ের মধ্যে একটা বিন্দুতে। অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব। যা অত্যন্ত গভীর আর সুপরিবেশিত এক দর্শন। রূপ, সনাতন প্রমুখ ওঁর শিষ্যদের লেখনী ও জীবনীতে সে ধারা আরো স্পষ্ট।
আসলে মহাপ্রভুতুল্য যখন একজন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়, তখন শুধু মাত্র তাঁর ব্যক্তিজীবনটায় তাঁকে ধরা যায় না, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে যে আদর্শটা প্রকাশিত হয় তাকেও গভীরভাবে অনুধ্যান করতে হয়। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণর ক্ষেত্রেও। শুধু স্বামীজি নন, শ্রীরামকৃষ্ণের বাকি গৃহী ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের জীবনী, লেখালেখি অনুধ্যান না করলে শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে ধারণাও অস্বচ্ছ থেকে যাবে।
যেমন একজন বাজারে যখন যায়, সে বাজারটাকে নিজের পুঁজি অনুযায়ীই দেখে। তেমনই বড় পুঁজিওয়ালা মানুষের দিকে তাকালে বাজারের ব্যাপ্তি সম্বন্ধে একটা সম্যক জ্ঞান জন্মায়। শ্রীরামকৃষ্ণর সময় এমন মানুষও ছিলেন যাদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ একজন স্নায়ুরুগী ছাড়া বিশেষ কিছু ছিলেন না। ওই যে বললাম, যার যেমন পুঁজি।
আগের প্রসঙ্গে আসি আবার, শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনে যেমন শঙ্করাচার্য ধারা, রামানুজ ধারার প্রভাব বেশি। অর্থাৎ অদ্বৈতভাব আর বিশিষ্টাদ্বৈতভাব। বিশিষ্টাদ্বৈতভাবকে বেলের সঙ্গে তুলনা করছেন। বলছেন বেলের শাঁসটাই আসল, কিন্তু গোটা বেল বলতে গেলে ও বিচি, খোল সব সমেত বলতে হবে।
বাঙালির চেতনায় সে অর্থে শ্রীরামচন্দ্র আলোচনায় আসেননি। সাহিত্যের কথা বলছি না, আমি অধ্যাত্মজগতের কথা বলছি। যদিও কথামৃতে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় শ্রীরামচন্দ্রর প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও শ্রদ্ধার সঙ্গেই এসেছে।
কিন্তু বাঙালির ইষ্টচেতনা জুড়ে আছেন জগদম্বা, শ্রীকৃষ্ণ আর বৌদ্ধ-বৈষ্ণব চেতনায় সিক্ত ব্রহ্ম। এ ছাড়া বাঙালি বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লোকনাথবাবা থেকে শুরু করে শীতলা সব পুজোতেই আছে। কিন্তু সেটাকে অধ্যাত্মিক চেতনা বলতে চাই না। সেটা তার উৎসব। সেটা তার বিশ্বাস। কিন্তু অধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যে একটা চর্চা শব্দ আছে। সেই চর্চা পাঁচালি পাঠ নয়। মননে উপস্থিতি, যা তার অবচেতনে থেকে তার ভাবনা চিন্তাকে প্রভাবিত করে চলেছে। তাকে বুঝতে গেলে এই গভীরতায় ডুবতেই হবে।
আমেরিকান সামাজিক মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ই নিসবেটের বই ‘দ্য জিওগ্রাফি অব থট’’, এই চিন্তার প্রভাবকগুলোর দিকটা নিয়ে আলোচনা করে। তার কাজ অবশ্যই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যে কাজটা স্বামী বিবেকানন্দ বহু বছর আগে শুরু করেছিলেন, সেই একই কাজ কিন্তু আরো বেশি তথ্য নির্ভর এই যা।
ইষ্ট শব্দটার শুরুর শব্দ ইচ্ছা। আমি যাকে ইচ্ছা করেছি বেছে নিতে। আমি যাকে বেছে নিই, পরে সে-ই আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শেষে এইটুকুই বলার আজ যে শ্রীরামের আবির্ভাব ভারতীয় রাজনীতিতে হয়েছে, সে রামের সঙ্গে ভারতের অধ্যাত্ম জগতের রামের অনেক পার্থক্য। কী করে? রামচরিতমানস যে বইটাকে মূলত আধার করে লেখা হয়েছিল সেটা হল ‘'অধ্যাত্ম রামায়ণ’। যা অত্যন্ত উন্নত মানের দর্শন। মূলত অদ্বৈতবাদের ভিত্তিতে ভক্তি আর জ্ঞানের সমন্বয়। শ্রীরামকৃষ্ণর ভীষণ প্রিয় গ্রন্থ। স্বামীজিকেই বিশেষত পড়তে দিতেন। আলোচনাও করতেন স্বামীজির সঙ্গেই।
যে রামের ছবি ‘'অধ্যাত্ম রামায়ণ’’ এ পাওয়া যায়, সেই রামের সঙ্গে পতাকা, মিছিল যায় না। শ্রীরামচন্দ্রর সাধনার রাস্তা বৈষ্ণবের সাধনার রাস্তা। সেখানে বৈষ্ণব বলতে কী বোঝায় আমরা নিশ্চয়ই জানি। আমার ধর্ম নিয়ে আমি আছি, সেখানে তুমি বাধা দিতে এলে আমি গর্জে উঠব, কিন্তু অকারণে গর্জন-তর্জনের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্রর না।
দস্যু রত্নাকর রাম নাম জপ করে সাধু হয়েছিলেন। তর্জন গর্জন করে হননি। মহাত্মা বলতেন, মুখে রামনাম আর বগলে ছোরা। এ ঠিক রাস্তা না। রামকে পাওয়ার একমাত্র সাধন তুলসীদাস বলছেন, ভালোবাসা। প্রেম। তার জন্য কি মিছিলে বেরোতে হয়?